স্যাবাইনা পার্কের কালো দিন: ক্রিকেটের অপমান

৩০ জানুয়ারি, ১৯৯৮। ক্রিকেট পাড়ায় তখন বেশ হৈচৈ। বিশ্ব মিডিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যাবাইনা পার্ক নিয়ে কটুক্তি সহ সমালোচনায় মুখর।

‘আ ডে অব শেম’, ‘ইনসাল্ট ফর ক্রিকেট’ – সহ বিভিন্ন শিরোনামে সয়লাব ছিল গণমাধ্যমগুলোর প্রথম পাতাতেই। কারণ আগের দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবিনা পার্কে যে ঘটে গেছে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার প্রথম টেস্টের প্রথম দিনে খেলা শুরুর মাত্র ঘন্টা খানেকের মাঝেই ‘পরিত্যক্ত পিচ’-এর কারণে পুরো টেস্টই বাতিল ঘোষণা করা হয়! এমন অপমানজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে সেবারই প্রথম।

২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৮। কিংসটনের স্যাবাইনা পার্কে ৬ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টে মুখোমুখি ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ইংলিশ অধিনায়ক মাইক আথারটন। ডায়রিয়ার কারণে ম্যাচের মাত্র এক ঘন্টা আগে বাদ পড়েন ইংলিশ উইকেটরক্ষক ব্যাটার জ্যাক রাসেল। টসের কিছু সময় আগে তাঁর জায়গায় দলে নেওয়া হয় মার্ক বাচারকে। অপরদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ওই ম্যাচে অভিষিক্ত হন নিক্সন ম্যাকলিন।

ইংলিশদের হয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নামেন আথারটন ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট। খেলা শুরু হতেই দেখা গেল পিচের অদ্ভুত আচরণ! কোর্টনি ওয়ালশের গুড লেন্থে করা তৃতীয় বলটি হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে আথারটনের নাকের পাশে দিয়ে যায়! ক্যারিবিয়ান পেসার কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যাম্ব্রোসদের বলের লাইন, লেন্থ কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না দুই ইংলিশ ওপেনার। কারণ কোনো বল অতিরিক্ত লো হচ্ছে তো কোনো বল অতিরিক্ত বাউন্স! এছাড়া অপ্রত্যাশিত স্যুইংয়ে ব্যাটারদের নাজেহাল অবস্থা।

এরপর ওয়ালশের বাউন্সারে দিশেহারা আথারটন ফেরেন দলীয় ৪ রানে। পরের বলেই আউট মার্ক বাচারও! ওয়ালশের লেন্থ বল কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতিরিক্ত বাউন্সে বাচারের মুখ বরাবর আঘাত হানতে যায়! সেটিকে লাফিয়ে ডিফেন্স করতে গিয়েই স্লিপে ধরা পড়েন তিনি।

৪ রানেই ইংল্যান্ডের দুই উইকেট নেই। তৃতীয় ওভারের শুরুতেই উইকেটের বেহাল দশা দেখে ইতিমধ্যেই অন ফিল্ড আম্পায়ার শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন ওয়াকিটকির মাধ্যমে ম্যাচ রেফারি ব্যারি জার্মানের কাছে বিষয়টি অবহিত করলেন। ব্যারিও অবশ্য পিচের অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করছিলেন এবং তিনিও বুঝতে পারছিলেন এই পিচ খেলার অনুপযুক্ত। অবশ্য আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী পিচ সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় সিদ্ধান্তটা আম্পায়ারকেই নিতে হবে।

তবে আম্পায়াররা খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। একপ্রান্তে অ্যালেক স্টুয়ার্ট একের পর এক বলের আঘাত সহ্য করে যাচ্ছিলেন। ক্রমশ যেন এই পিচ আরো বিপদজনক হয়ে উঠছিল ব্যাটারদের জন্য! দলীয় ৯ রানে অ্যাম্ব্রোসের বাউন্সারে এজ হয়ে সেকেন্ড স্লিপে কার্ল হুপারের কাছে ধরা পড়েন নাসের হুসেইন। অ্যালেকের সাথে যোগ দিলেন গ্রাহাম থ্রপি। ড্রেসিং রুমে ফিরে আথারটনকে নাসের বললেন, ‘এই পিচ খেলার অবস্থায় নেই!’ আথারটন ইতিমধ্যে ম্যাচ রেফারির সাথেও আলাপ করলেন।

খেলার ৩৫ মিনিটেই দলের ৩ উইকেট নেই। পিচের এমন অবস্থার কারণে ব্যাটারদের বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। কারণ ওয়ালশ, অ্যাম্ব্রোসদের বল অস্বাভাবিক স্যুইংয়ে বার বার ইংলিশ ব্যাটারদের শরীরে আঘাত হানছিল।

দলীয় ১৩ রানে কোর্টনি ওয়ালশের ফুলার লেন্থের বল একদম জাদুর মত উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে সীমানারা বাইরে! বাই চার! ওয়ালশ নিজেও যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ওই ওভারেই নতুন ব্যাটার গ্রাহাম থ্রপির ডান হাতে আঘাত হানে বল। এমন অবস্থা দেখে ড্রেসিং রুমে ব্যাট হাতে অপেক্ষমান জন ক্রাউলি তখন অনেকটা ভয়ের স্বরেই বলছিলেন, ‘ওহ  ঈশ্বর, এই পিচে আজ কেউ হয়তো মারা পড়বে!’

খেলা তখন ৫৬ মিনিট শেষ। ইংলিশ ফিজিও ওয়াইন মরটন ১ ঘন্টার মধ্যে ৬ বার মাঠে আসা যাওয়া করেছেন! পরবর্তীতে তিনি অবশ্য বলেছিলেন, এমন অবস্থা ক্যারিয়ারে আর কখনোই তিনি সম্মুখীন হননি। এই ৫৬ মিনিটে অ্যালেক তিনবার ও থ্রপি দুইবার হাতে এবং পিঠে আঘাত পেয়েছেন। আম্পায়াররা পানি পানের বিরতি দিতেই এবার মাঠে ছুটে আসলেন আথারটন। ফিল্ড আম্পায়ার ও ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ব্রায়ান লারার সাথে প্রায় বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলেন।

প্রায় ১২ মিনিট মাঠের মাঝে আলাপ শেষে আম্পায়াররা সিদ্ধান্ত নিলেন এই পিচ খেলার অনুপযোগী হওয়ায় ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। লন্ডনে আইসিসির কাছেও সার্বিক অবস্থা জানালে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তে সায় দেয় আইসিসি।

ওই ম্যাচ ছিল অধিনায়ক হিসেবে ব্রায়ান লারার প্রথম ম্যাচ! তাও আবার জ্যামাইকান তারকা কোর্টনি ওয়ালশের জায়গায় অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। জ্যামাইকার মানুষ এই সিদ্ধান্তে এমনিতেই ছিলেন প্রচন্ড ক্ষোভে। এমনকি শোনা যাচ্ছিল মাঠে দর্শকরা লারাকে দুয়ো দিতে যাবেন! ম্যাচ বাতিলের সিদ্ধান্তের সময় তাই লারা আথারটনকে বলেই ফেললেন, ‘এই সিদ্ধান্তটা তুমিই নাও, এমনিতেই জ্যামাইকার মানুষের কাছে ভৎসনা পাচ্ছি।’


জ্যামাইকার ঘড়িতে তখন ১১ টা বেজে ২০ মিনিট। আইসিসি ও দুই দলের অধিনায়কের সাথে আলোচনার পর আম্পায়াররা খেলা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করলেন। টেস্ট ইতিহাসে ১২২ বছরে প্রথমবার পিচের কারণে ম্যাচ বাতিল ঘোষণা করা হয়। মাত্র ১০.১ ওভারে ৩ উইকেটে ১৭ রান করেন ইংলিশরা। একটি নো বলসহ ওই টেস্টে মোটে ৬২ বল খেলা হয়। টেস্ট ইতিহাসে বলের হিসেবে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ম্যাচ হিসেবে সাবিনা টেস্ট জায়গা পেয়েছে রেকর্ড তালিকায়।

ওই সিরিজের মাত্র তিন মাস আগেই সাবিনার উইকেট খোঁড়া হয় নতুন ভাবে প্রস্তুত করার জন্য। ম্যাচের আগেও পিচের অবস্থা দেখে ধারাভাষ্যকাররা সহ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন আদৌ এই উইকেট প্রস্তুত কিনা ম্যাচের জন্য! মূলত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কিছুটা স্লো উইকেট তৈরি করে বাড়তি সুবিধা পাওয়াই জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে ছিল।

তবে পিচ পুরোপুরি তৈরি হয়েছিল কিনা এই নিয়েও ছিল প্রশ্ন। ইংলিশ অধিনায়ক মাইক আথারটন অবশ্য পরবর্তীতে বলেছিলেন, ‘টসের আগে আমি দেখেছি পিচের বেশ কিছু অংশে ফাটল আছে। তাঁরা সেই ফাঁকা জায়গা গুলো কিছু একটা দিয়ে পূরণ করতে চাচ্ছিল।’

জ্যামাইকার পিচ কিউরেটর চার্লি জোসেফ ও জ্যামাইকা ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী জর্জ প্রেসকোড খেলার আগেই বলেছিলেন, ‘এটা একদম প্রস্তুত’। এমনকি গ্রাউন্ড সুপারভাইজার ইস্টন ম্যাকমরিস তো ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘আমরা আশাবাদী এখানে ৩৮০ রান হবে!’

পরবর্তীতে ওই টেস্ট বাতিলের সাথে সাথেই সাবাইনা পার্কের কিউরেটর চার্লি জোসেফকে বরখাস্ত করা হয়। চার্লি ৪৯ বছর যাবত সাবাইনার উইকেটে তৈরির দায়িত্বে ছিলেন! এমনকি সর্বকালের সেরা পিচ কিউরেটরদের একজন মানা হয় চার্লিকে।

ওই ঘটনার পর চার্লি বলেছিলেন, ‘আমি মাঠে গিয়ে দেখি ইংলিশ দর্শকরা বিয়ারের বোতল ছুঁড়ে মারছে। ২৯ জানুয়ারি, ১৯৯৮ সালের ১১ টা ২০ মিনিটে ওই টেস্টের সাথে সাথে আমারও মৃত্যু হয়েছে। সাবিনাকে আমি আমার মেয়ের মত ভালবাসতাম। আমি কখনোই এমন কিছু করার চেষ্টা করিনি। উইকেট অনেক যত্ন নিয়েই বানাতাম। আমার জন্য লজ্জাজনক হল আমার কারণে সাবিনার গায়ে দাগ লেগেছে।’

ওই টেস্ট পরিত্যক্ত হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন দর্শক সহ ক্রিকেট সমর্থকরা। অবশ্য ম্যাচ দেখতে আসা সবাইকেই টিকেটের টাকা রিফান্ড করা হবে বলে জানানো হয় কর্তৃপক্ষ থেকে। মাঠে থাকা ৪ হাজার দর্শকের মাঝে প্রায় শ’পাঁচেক ইংলিশ সমর্থকও এসেছিলেন। তবে ওই লজ্জাজনক কান্ডের পরই জ্যামাইকায় ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

অবশ্য ম্যাচ বাতিলের কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওই টেস্ট ভিন্ন ভেন্যুতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে জ্যামাইকার ব্রিজটাউন ও সেন্ট জোনসেও উইকেটের কাজ চলায় খেলার জন্য ছিল একেবারেই অনুপযোগী। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হয় পরের টেস্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ বাদ দিয়ে ওই সময় পুনরায় এই টেস্টটি আয়োজন করা হবে। তবে আইসিসি বেশ কয়েকদিন আলোচনার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় এই টেস্টটি আর হবে না এবং এই টেস্টের সব রেকর্ড খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারে যোগ হবে।

এর মাধ্যমে সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জ্যাক ম্যাকব্রায়ানের মতই অভিষেকে বোলিং, ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিং তিন বিভাগেই কিছুর সুযোগ পাননি নিক্সন ম্যাকলিন। অবশ্য ম্যাকলিন পরবর্তীতে ১৯ টেস্টে খেললেও ম্যাকব্রায়ান অভিষেক টেস্টের পর আর খেলার সুযোগ পাননি।

ম্যাচ বাতিলের পরের দিনই আথারটন মাঠে গিয়েছিলেন উইকেটের অবস্থা দেখার জন্য। দেখলেন আগের দিনের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। তখন তিনি ভাবলেন, ‘ম্যাচ বাতিলের সিদ্ধান্তটাই আসলে সঠিক ছিল।’

ওই টেস্ট বাতিলের পর বিশ্ব মিডিয়ায় সাবিনা পার্ক টেস্টকে অপমানজনক, লজ্জাজনক, হাস্যকর, নজিরবিহীন, অবিশ্বাস্য সহ বিভিন্ন কটুক্তিমূলক শব্দে আখ্যা দেয়। দ্য গ্লিনারের এডিটর তো মাঠেই বলেছিলেন, ‘যারা এই পিচ তৈরির সাথে জড়িত তাদেরকেই এখানে পুঁতে রাখা উচিত। এটা তাঁদেরই দায়।’

তবে অ্যালেক স্টুয়ার্টের ২৬ বলে করা অপরাজিত ওই ৯ রানের ইনিংসকে ইতিহাসের অন্যতম সাহসী ইনিংস হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আরেকটি দারুন ব্যাপার ছিল ওই টেস্টে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অন ফিল্ড আম্পায়ার ভেঙ্কটরাঘবনকেই ম্যাচ সেরা ঘোষণা দেওয়া হয়!

সাবিনা পার্কের ওই টেস্ট বাতিলের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট। অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে স্বীকার করা হয় এই উইকেট খেলার জন্য উপযুক্ত ছিল না। এর এক বছর বাদেই একই ভেন্যুতে খেলতে আসে অস্ট্রেলিয়া। সেবার অবশ্য ভাল উইকেট দেখে অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ বেশ প্রশংসাই করেছিলেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link