বয়সটা নিতান্তই কম। মাত্র ১৪ বছর। তখন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা নামক এক কিশোরকে বেশ জটিল একটা সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছিলো। হয়ত তিনি ক্রিকেটার হবেন নয়ত ভলিবল খেলোয়াড়। লম্বা গঢ়নের এই কিশোর এই দুইটি খেলাই বেশ রপ্ত করতে পেরেছিলো ছোট্ট বেলাতেই। সেক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর ডিএনএ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেননা তাঁর বাবা-মা দুইজনই একসময় যুক্ত ছিলেন খেলাধুলার সাথে।
প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার বাবা ছিলেন একজন ফাস্ট বোলার। খেলেছেন স্কুল-কলেজের ক্রিকেট দলের হয়ে। আর মা তো রীতিমতো স্টেট লেভেলে খেলেছেন ভলিবল। দোলাচলের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে হাজির হলেন প্রসিদ্ধের স্কুল কোচ শ্রীনিবাস মূর্তি। তিনি উপদেশ দিলেন ক্রিকেটেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। শ্রীনিবাস নিজেও খেলেছিলেন প্রথম শ্রেণি ক্রিকেট। তাঁর কথা মেনেই বাবার ফেলে আসা অপূর্ণ পথে হেঁটে পূর্ণতা দিতে।
শ্রীনিবাসের সেই উপদেশ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার বাবা মুরালি কৃষ্ণা বলেন, ‘সে (প্রসিদ্ধ) তাঁর বয়সের বাকি সবার থেকে লম্বা ছিলো এবং অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন সময়েই সে বেশ দ্রুতগতিতে বল করতে পারতো। তাই কোচ শ্রীনিবাস বললেন যে আমার ছেলে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলা উচিৎ। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ক্রিকেটার হবে।’
বয়সভিত্তিক দলে তাঁর যাত্রা খুব একটা এবড়ো-থেবড়ো ছিলো। অনায়াসে তিনি তাঁর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের যাত্রা শেষ করে পা রাখেন প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে। কর্ণাটকের হয়ে ২০১৫-১৬ মৌসুমে তাঁর প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটের অভিষেক হয়। দুই বছর সময় দিয়েছেন চেন্নাইয়ে অবস্থিত এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে। সেখানে তিনি নিজের স্কিল এর উন্নয়নের পাশাপাশি ফিটনেসের দিকেও নজড় দিয়েছেন। নিজেকে পরিণত করেন একজন আগামী দিনের সম্ভাবনায়।
এরপর ২০১৬/১৭ মৌসুমের প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার অভিষেক হয় লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে। অভিষেক মৌসুমেই তিনি তুলে নেন ১৩টি উইকেট। সেই মৌসুমে তাঁর গড় ছিলো ১৬.৬। এর পরের বছর তিনি ১৭ উইকেট নিয়ে বনে যান বিজয় হাজরা ট্রফির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। সময়ের পরিক্রমায় নিজেকে যেন আরো বেশি পরিণত করতে থাকেন প্রসিদ্ধ। বিজয় হাজরা ট্রফির ভাল পারফর্মেন্সের বদৌলতে তিনি ডাক পেয়ে যান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) দল কলকাতা নাইট রাইডার্সে।
একই সাথে ভারত-এ দলের হয়েও বেশ কয়েকটি ট্যুরে তিনি ছিলেন নিয়মিত। তিনি যেন খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এইতো বুঝি ছুঁয়ে ফেললেন জাতীয় দলের জার্সিটি। তবে প্রসিদ্ধের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি বড্ড ধৈর্যশীল। তাঁর বিষয়ে তাঁর কর্ণাটক সতীর্থ বলেছেন, ‘সে একটা জায়গায় সবার থেকে আলাদা। সে কঠিন পরিস্থিতিতেও সে বড্ড শান্ত থাকতে পারে। এই একটা গুণ তাঁর মধ্যে শুরু থেকেই আছে।’ মাথা ঠাণ্ডা প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে শুধু অপেক্ষা করছিলেন সঠিক সময়ের।
সেই সময়টা অবশেষে এলো তাঁর জীবনে। গেলো বছর মার্চে জাতীয় দলের জার্সিটা প্রথমবারের মতো গায়ে তোলেন প্রসিদ্ধ। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর অভিষেক হয়। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি সবাইকে চমকে দেন তাঁর পারফর্মেন্স দিয়ে। ইংল্যান্ডের বাঘা-বাঘা ব্যাটারদের চারটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর থেকেও অবাক করা বিষয় ছিলো সে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে বল করেছেন নিয়মিত। তবে তা ছাপিয়ে গেছে তাঁর ক্রিকেটিয় বুদ্ধিদীপ্ততা ও ধৈর্য্য।
শুরুর দিকে প্রসিদ্ধর উপর চড়াও হয়েছিলেন ইংলিশ ব্যাটাররা। তবে নিজের মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বল করে গেছেন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। যার ফলাফল হিসেবে ভারতীয় পেস বোলারদের মধ্যে অভিষেকে সেরা বোলিং ফিগারের মালিক এখন তিনি। ভারতের সাবেক অধিনায়ক বিরাট কোহলি প্রসিদ্ধকে ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন।
ইংল্যান্ড সিরিজের পর তিনি একটি ম্যাচ খেলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। প্রোটিয়াদের ঘরের মাঠেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে তিনি তুলে নিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। নিজের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ধরে রেখে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা সুযোগ পান চলতি বছরের প্রথম হোম সিরিজে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এখন অবধি দুইটি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। শেষ ম্যাচে চার উইকেট সহ সিরিজে এখন পর্যন্ত তাঁর নেওয়া উইকেটের সংখ্যা ছয়টি।
নিজের ঝুলিতে থাকা সবগুলো অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে বাইশ গজে খাবি খাওয়াচ্ছেন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা। বাউন্সার, যথাযথ লাইন-লেন্থ, গতি এবং বুদ্ধিমত্তা এসবকিছুর মিশেলে কৃষ্ণা ক্রমশই যেন জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিচ্ছেন। হয়ত ভারতও তাঁর আগামী দিনের পরিকল্পনায় প্রসিদ্ধ কৃষ্ণার মতো একজন প্রতিভাবান পেস বোলারকে রেখেই সাঁজাবে প্রতিপক্ষ বধের রণকৌশল।
মুদ্রার অপর পাশটায় যদি প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা একজন ভলিবল খেলোয়াড় হতেন তবে কি হতো? তিনি কি পারতেন স্টেট লেভেলের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসতে? হয়ত পারতেন। কেননা তিনি তো ছিলেন ধৈর্য্যশীল এক কিশোর। সময়ে পরিক্রমায় যে হয়েছে আরো শান্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। তবে ভলিবল খেলোয়াড় প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা হয়ত এত দ্রুতই আসতে পারতেন না লাইমলাইটে। সে অন্য গল্প অন্য আলাপ। অন্যভূবন যদি থেকেই থাকে হয়ত সেখানে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা একজন ভলিবল খেলোয়াড়।