যুদ্ধে হারানো ফুল

অসাধারণ ব্যাটিং প্রতিভার জন্য তাঁকে ক্রিকেটভক্তরা ডাকতো ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ বলে। খোদ স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানও তাঁর ব্যাটিংয়ের গুণমুগ্ধতা স্বীকার করে গেছেন। কিন্তু ক্যারিবিয়ানরা গ্রেটরা তা শুনলে তেতে উঠেন, জর্জ হেডলিকে কারো তুলনা হতে দিতে রাজি না তাঁরা। ক্লাইভ লয়েড তো বলেই ফেলেছিলেন, কেন তাকেই ব্র্যাডম্যান তকমা দেয়া হচ্ছে, ব্র্যাডম্যানকে কেন সাদা হেডলি ডাকা হবে না!

এই উদ্ধত শ্রদ্ধা হ্যাডলির প্রাপ্য। কারণ ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে প্রথম আলোকবর্তিকা তিনি, গাভাষ্কারের ব্যাটিং যেমন শচীন, দ্রাবিড়দের যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, অজিরা ক্রিকেট খেলা বোঝা মাত্রই ব্র্যাডম্যান হতে চাইত, জর্জ হেডলিও সত্তরের দশকের সেই কালজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটার কাছে তেমন কিছুই ছিলেন।

১৯৩০ সালের ইংল্যান্ড ক্রিকেট মৌসুম শুরু করল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে সফরে গিয়ে। খেলতে হবে চারটি টেস্ট।

ক্যারিবিয়ানরা তখনো ক্লাইভ লয়েডের মত সর্বগ্রাসী দল হয়ে উঠেনি, সদ্য নবীন টেস্ট সদস্য দলটিকে সবচেয়ে দুর্বল দল বলা চলত, আর ইংল্যান্ড স্বভাবসুলভ আভিজাত্যে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম প্রতাপশালী দল।

আর সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ড্র করে ফেলল প্রথম টেস্টেই! পেছনের কারিগর দু’জন, একজন প্রথম ইনিংসে খেলেন ১২২ রানের ইনিংস আরেকজন অভিষেক টেস্টেই খেলে বসেন ১৭৬ রানের ইনিংস। একজনের নাম ক্লিফর্ড রোচ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, অন্যজন অভিষিক্ত জর্জ হেডলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অভিষেকে সেঞ্চুরি পাওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান। সে সিরিজে সর্বোচ্চ ৭০৫ রান করে সবার নজরে পড়েছিলেন।

আজকের গল্পটা দ্বিতীয় জনকে নিয়েই। খেলতে পেরেছিলেন ২২ টেস্ট, এতেই তাঁর সাথে ব্রাডম্যানের নাম জড়িয়ে যায়, কারণ তার শট খেলার ক্ষমতা, রান করার ক্ষুদা ও অবিশ্বাস্য গড়।

তাঁর শট রেঞ্জ ছিল বড়, পুরো মাঠ জুড়েই শট খেলতে পারতেন, বল জাজমেন্ট ছিল ভাল, ডিফেন্স করতে জানতেন। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করতে থাকা নবীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য তিনি হয়ে এসেছিলেন আশীর্বাদ। ব্যাটিংস্তম্ভ হয়ে দলকে টেনেছেন একাই।

পরবর্তীতে রাজত্ব করা বিশ্বজয়ী দলটির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বাসটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে চাইলে একাই গড়া যাবে ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্য। এখনও অন্তত ২০ টির বেশি টেস্ট খেলা এবং অবসর নেয়া ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি গড় (৬০.৮৩) আছে শুধু ডন (৯৯.৯৪) এবং গ্রায়েম পোলকের (৬০.৯৭)।

একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলে ব্যাপারটা আরও ভাল বোঝা যাবে, তার প্রথম ১৯ টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সর্বমোট রান করে ৮৩৩৫, এর মধ্যে হেডলির রান ছিল ২১৩৫, অর্থাৎ, দলীয় রানের ২৫.৬১% রান ছিল তাঁর করা। এছাড়াও দলের জয় পাওয়া ম্যাচে তার গড় ছিল ৯৫.৭৫!

প্রথম সিরিজটা স্বপ্নের মত কাটলেও হেডলির নিজেকে প্রমাণ করার বাকি ছিল। কারণ ইংল্যান্ডের সেই দলটাও তেমন শক্তিশালী ছিল না, মূলত এমসিসির পুরনো কিছু ক্রিকেটার যারা অবসরের অপেক্ষায় আছেন এবং কখনো ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেননি এবং একদমই তরুণ ক্রিকেটার যাদের ইংল্যান্ডের হয়ে এর আগে খেলা হয়নি, তাঁদেরকেই পাঠানো হয়েছিল ক্যারিবিয়ান সফরে। তাই হেডলিকে নিজেকে প্রমাণ করতে হতো আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সফরে।

অস্ট্রেলিয়া সফরের শুরুতে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে প্রথম শ্রেণীর দুই ম্যাচে হেডলি ৮২ এবং ১৩১ রানের ইনিংস খেলেন, এরমধ্যে ১৩১ কে ভিক্টোরিয়ার গ্রাউন্ডে সেরা ইনিংস বলেছিলেন সমালোচকরা। কিন্তু অফসাইডের দুর্দান্ত হ্যাডলি লেগসাইডে যে একদমই বল পাঠাচ্ছেন না এটা দেখার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম দুই টেস্টে লেগস্পিনার ক্ল্যারি গ্লিমেটের সামনেই রীতিমত নাকাল হন হেডলি। ফলে ব্যাটিং স্ট্যান্স পাল্টে তৃতীয় টেস্টে স্ট্রোক ঝলমল ১১৩ রানের এক ইনিংস খেলেছিলেন। সমালোচকরাও বুঝে গেলেন মহারথী আসছে।

এরপর থেকে ধ্বজভঙ্গ ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং বিপর্যয়ে হেডলি ক্যারিবিয়ানদের ইনিংস মেরামতে নিয়মিত পারফর্ম করে গেছেন। তবে নিজের ক্যারিয়ারের শিখরে উঠতে শুরু করেন ১৯৩৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে। ব্রিটিশ মিডিয়া অপেক্ষায় ছিল ইংলিশ কন্ডিশনে হেডলির সামর্থ্য দেখার।

হেডলি তাঁদের নিরাশ করলেন না, দলের মলিন ফলাফলেও তিনি প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন। তৎকালীন সেরা ইংলিশ বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৬৯ রানের ইনিংস সমালোচকদের তুমুল প্রশংসা আদায় করে।

এছাড়াও সেই সফরে আন-অফিশিয়াল একটি ম্যাচে নোরফোল্কের বিপক্ষে তিনি খেলেন ২৫৭ রানের এক ইনিংস। সেই পারফর্মের দরুন ইংলিশ ঘরোয়া ক্রিকেটে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে খেলার প্রস্তাব পান এই ব্যাটসম্যান।

পারিশ্রমিক হিসেবে তখনকার দিনে মৌসুমপ্রতি ৫০০ পাউন্ড পেতেন তিনি, পেশায় ফল বিক্রেতা এই ক্রিকেটারের জন্য যা ছিল বহুমূল্য। দুই বছরে ৩৭ গড়ে ৬৭৭ রান ও ৭৬ উইকেট নিয়ে এর প্রতিদানও দেন তিনি।

কিন্তু ক্রিকেটেরই দুর্ভাগ্য, এই প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ২২ টি টেস্ট। কারণ, ১৯ টেস্ট খেলার পরই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

বিশ্বযুদ্ধ মৃত্যু ঘটাল এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার। তাঁর গড়ের পার্থক্য দেখলেই বুঝা যাবে তা, যুদ্ধের আগে তাঁর গড় ছিল ৬৬.৭১, বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৪৬ বছর বয়সী হেডলি খেলতে পারেন তিনটি টেস্ট, যেখানে তার গড় ছিল ১০.৬৫।

মূলত যুদ্ধই এই কিংবদন্তির আর্ন্তজাতিক ক্যারিয়ার লম্বা করতে দেয়নি। তবে তাঁর প্রথম শ্রেণীর পরিসংখ্যান দুর্দান্ত। ১০৩ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৯৯২১ রান করছিলেন ৬৯.২৬ গড়ে। ১৯৮৩ সালের ৩০ নভেম্বর ৭৪ বছর বয়সে জ্যামাইকার কিংস্টনে এই কিংবদন্তি মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link