রামোস, দ্য গ্ল্যাডিয়েটর্স

সময় এগিয়ে যাচ্ছে, একই শহরের দুইটি মানুষ এর কাছে তখন ছিল দুই অনুভূতি। না,অনুভূতি তখন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। ইনজুরি সময়ের তিন মিনিটের দুই মিনিট শেষ; একটি গোলের জন্য তখন মরিয়া রিয়াল মাদ্রিদ অন্যদিকে, নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের অপেক্ষা শেষ বাঁশির জন্য। ম্যাচের একেবারে অন্তিম মূহুর্তে কর্নার পায় রিয়াল মাদ্রিদ।

কর্নার থেকে নেওয়া লুকা মদ্রিচের শটটা উড়ে আসছিলে, গোল পোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বেল-রোনালদোকে ছাড়িয়ে বাঁক নেওয়ার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে এক টগবগে তরুণ বলে মাথা ছুঁইয়ে সময়টাকে স্থির করে দিলেন; ৯২.৪৮ এই থামিয়ে দিলেন ঘড়ির কাঁটা। প্লেসিং হেডে গোলকিপারের আপ্রান চেষ্টাকে ব্যর্থ করে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের সমতা ফেরালেন। সেই ২০১৪ এর গল্প, সেই লা ডেসিমা জয়ের কাহিনি বলা হলো যে গল্পের নায়ক সার্জিও রামোস,এল ক্যাপিতানো, যার রেকর্ড একটানা তিন বার ইউরোপসেরার মুকুট জেতার কৃতিত্ব ছুঁয়ে দেখতে পারেনি আর কোন অধিনায়ক।

১৯৮৬ সালের ৩০শে মার্চ স্পেনের সেভিয়ায় জন্ম নেওয়া রামোসের হাতেখড়ি হয়েছিল ক্লাব সেভিয়াতেই। পেশাদার ফুটবলের শুরুটাও সেখানেই। ক্যারিয়ারের শুরুতে উইঙ্গার হিসেবে খেললেও একসময় নিচে নেমে ফুলব্যাক হিসেবে খেলা শুরু করেন রামোস। কিন্তু যার রাজকীয় রক্ত তার গন্তব্য তো রয়্যাল রিয়াল মাদ্রিদ।

তাই রাজকীয় রক্তের বাহক সার্জিও রামোসও ২০০৫ সালে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে আসেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু-তে। এরপর থেকেই নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছেন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের আভিজাত্যকে। ফুলব্যাক হয়ে খেলতে খেলতে একসময় সেন্টার ব্যাক পজিশনেই খেলা শুরু করেন তিনি। রিয়ালে থাকাকালীন পর্তুগিজ সেন্টারব্যাক পেপে এর সাথে গড়েছিলেন একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ জুটি।

নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে একজন ডিফেন্ডার সার্জিও রামোস হয়ে উঠেছিলেন ‘গ্ল্যাডিয়েটর’। লা ডেসিমা’তে আর্মব্যান্ডহীন কাপ্তান ছিলেন, পরে ক্যাসিয়াসের উত্তরসূরি হয়ে রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরেছিলেন বাহুতে। ব্যাকেনবাওয়ের, মালদিনিদের মত সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারের সাথে নাম উচ্চারিত হয় মি.৯২.৪৮ এর। গ্যালোকটিকোদের ভিড়ে ক্যারিয়ার শুরু করা তরুণ এক রামোস নিজের আলোতেই সব ছাপিয়ে এসেছিলেন আলোর নিচে, সহজ ভাষায় ‘লাইমলাইট’-এ।

ডিফেন্ডার হয়েও লা লিগায় করেছেন করেছেন রেকর্ড ৭৪ গোল। আন্তর্জাতিক ম্যাচে করেছেন আরো ২৩ গোল। পুরো ক্যারিয়ারে ১২৬ গোল করা রামোস মাদ্রিদের হয়েই জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যারমধ্যে তিনটি একটানা তিন বছরে জিতেছিলেন।

এছাড়াও চারটি ক্লাব কাপ, পাঁচটি লা লিগ সহ রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সর্বমোট ২২টি ট্রফি জিতেছিলেন রামোস। লা লিগার ‘ডিফেন্ডার অব দ্য ইয়ার’ হয়েছেন তিনবার আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগে এই পুরুষ্কার পেয়েছিলেন দুইবার। স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ২০১০ সালে জিতেছেন বিশ্বকাপ; ২০০৮ এবং ২০১২ এর ইউরো-এর শিরোপা মঞ্চেও জায়গা পেয়েছিলেন। ফুটবল বিধাতা বোধহয় অপূর্ণ রাখেননি সার্জিও রামোসকে।

তবে রগচটা কাপ্তানিতে প্রায়ই প্রতিপক্ষের চক্ষু শূল হয়েছেন রামোস কিন্তু তাতে তার থোড়াই কেয়ার। দল আর সতীর্থরাই থাকে তার সবটুকু জুড়ে। তরুণ রামোস অভিজ্ঞ হয়েছেন ঠিকই তবে পাল্টাননি নিজেকে। পাল্টালে নিশ্চয়ই রামোস ‘রামোস’ থাকতেন না।

রামোসদের সৌন্দর্য তো রগচটা মনোভাব আর তেড়েফুঁড়ে যাওয়ার মাঝে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সর্বাধিনায়কের মতই যখন যেখানে প্রয়োজন, যেভাবে প্রয়োজন ছুটে গিয়েছেন; দলের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। মাঠে ঝরিয়েছেন রক্তও। মাদ্রিদের ঘরে ছেলে না হয়েও ক্লাবের প্রতি তার আনুগত্য আর ডেডিকশনে তাকে মি.মাদ্রিদম্যান বললে আপত্তি থাকার কথা নয় কারো ৷

আলোকোজ্জ্বল এক ক্যারিয়ারের শেষ সায়াহ্নে এসে মুদ্রার অন্ধকার দিকটিও দেখা হয়ে গিয়েছে তার। প্রায় ১৬ বছর পরে এই অবেলায় সার্জিও রামোসকে সাদা পোশাকের মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে; বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় রামোসকে যেতে হয়েছে অন্য ডেরায়। জড়াতে হয়েছে অন্য পোশাক। স্পেনের রাজধানী থেকে ফ্রান্সের সুউচ্চ আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে গিয়ে বাসা বেঁধেছেন।

তবু তিনি সার্জিও রামোস, তিনি ‘এল ক্যাপিতানো’। তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে রিয়ালের ইতিহাসে। তার অর্জন মিশে থাকবে সান্তিয়াগো ব্যার্নাব্যুয়ের দূর্বাদলে। তিনি থাকবেন প্রতিপক্ষের ভয়ার্ত হৃদকম্পনের কারণ হয়ে, থাকবেন প্রতিটি মাদ্রিদিস্তা’র বুকের মনিকোঠায়। আর হ্যাঁ, তিনি থাকবেন রেফারির সেই বুকপকেটের ছোট্ট নোটবুকেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link