নয়্যার দ্য ‘সুপার-কিপার’

হন্তদন্ত হয়ে ভাই ছুটে গেলেন ড্রয়িং বই হাতে। গিয়ে বললেন, ‘নয়্যার, তুমি তো তোমার ড্রয়িং বুক বাসায় ফেলে এসেছিলে।’ এমন করেই বড় ভাই মার্সেল ন্যয়ার ছোটভাই ম্যানুয়েল নয়্যারকে আগলে রেখেছিলেন। ছোট ভাইয়ের ঝোঁক ছিল খেলাধুলায়। আঁকা আঁকি তাঁকে দিয়ে খুব একটা হত না। তাই বড় ভাই মার্সেল নিজের হাতে এঁকে বাড়ির কাজের খাতা ওমর ফন্দি-ফিকির করে জমা দিতেন। তাই হয়ত আজ জার্মানির গোলদূর্গের অতন্দ্র প্রহরী হতে পেরেছে ম্যানুয়েল নয়্যার।

খুব ছোট বয়সেই নয়্যার ফুটবল খেলাটা বুঝতে শুরু করে, দেখতে শুরু করে এমনকি খেলতেও শুরু করে। যে বয়সে কেবল হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ক’কদম দৌড়ানোর কথা সে সময়ে তিনি ফুটবলকে আঁকড়ে ধরাটা শিখে নিয়েছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সেই শালকে জিরো ফোর অ্যাকেডেমিতে ভর্তি হয়ে যান নয়্যার। একেবারে গোড়াপত্তনেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই সেই তিনকাঠির নিচে।

আজকের এই ছয় ফুট দুই ইঞ্চির নয়্যার তখন ছিলেন সময়ের তুলনায় বেশ খর্বকায়। তাই হয়ত নেওয়া হয়েছিল সে সিদ্ধান্ত। আহা কেউ কি বুঝেছিল যে সে খর্বকায় একদিন হবে সুবিশাল, ছোট্ট এক শিশু থেকে হবে জগৎ বিখ্যাত গোলরক্ষক? ভাবেনি, ভাবার কথাও নয়। মানুষ তো আর ভবিষ্যৎ দেখতে পারে না। তবে নয়্যার যেন নিজেকে প্রস্তুত করতে বিন্দুমাত্র হেলাফেলা করেননি। বরং অপেক্ষায় ছিলেন সুযোগের।

আর সুযোগটা এসেই যায়, যখন তাঁর বয়স কেবল কুড়ি। এফসি শালকের নিয়মিত গোলকিপার ফ্রাঙ্ক রস্টের ইনজুরি নয়্যারের নতুন দিনের দুয়ার। ১৯ আগস্ট ২০০৬ সালে তিনি প্রথম পেশাদার ফুটবলে দস্তানা হাতে দাঁড়িয়ে যান গোলবারের নিচে। নিজেকে সে দিনটির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা নয়্যার কোন রকমের ভুলচুক ছাড়াই গোল না খেয়েই ম্যাচটি শেষ করেছিলেন।

তবে সেটা তো ছিল কেবল শুরু। সে মৌসুমে ১৯টি ম্যাচে তিনি প্রতিপক্ষের ছোঁড়া বল জড়াতে দেননি জালে। সেবার নয়্যারের সেই অনবদ্য পারফর্মেন্সের উপর ভর করেই বুন্দেসলিগার রানার্সআপ হয়েছিল। একটা স্বপ্নযাত্রার প্রারাম্ভ। এরপর তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ক্লাব পেরিয়ে হয়েছেন জার্মানির নিজস্ব দূর্গ। জার্মানির পন্যের কদর আছে টেকসই বলেই। সে দিক থেকে চীনের দূর্গ থেকেও হয়ত কয়েকগুণ স্থায়ীত্ব রয়েছে তাঁর।

তাছাড়া তিনি তো গোলরক্ষণের শিল্পকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তাঁর দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে। তাছাড়া ‘সুইপার গোলকিপার’ এই তত্ত্বটার যথাযথ এক উদাহরণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে। শুধু গোলরক্ষণ দক্ষতা নয়, বলের উপর তাঁর দখল, সুদূর প্রসারী দৃষ্টি আর সূক্ষ্ম পাস দেওয়ার সক্ষমতাও তিনি বাড়িয়েছেন সময়ের সাথে। হয়েছে এক ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’।

এমন অনবদ্য একজন গোলরক্ষক দলে থাকা মানেই নির্ভার হয়ে খেলতে পারার রসদ। তিনি যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন ততক্ষণ লক্ষ্য যেন অভেদ্য। এমন এক ভরসা জুগিয়েছেন বলেই তাঁর দল জিতেছে সম্ভাব্য সবকিছুই। একজন ইউরোপিয় ক্লাব ফুটবলার হিসেবে যতগুলো শিরোপা জেতা সম্ভব তাঁর সবকিছুই জিতেছেন ম্যানুয়েক নয়্যার। তবে এর পেছনে আরও একজন ব্যক্তির অবদান রয়েছে। তিনি টনি তাপালোভিচ।

হয়ত ফুটবল ভক্তদের কাছে এই নামটা খুব একটা সুপরিচিত নয়। তবে তিনি ছিলেন এফসি শালকের রিজার্ভ দলের গোলকিপার। তাঁর কাছ থেকে অনেক দূর্বলতা কাটিয়ে ওঠার দীক্ষা নিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন নয়্যার। ২০১৪ বিশ্বকাপে যার প্রতিফলন থেকে ফুটবল দুনিয়া। টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতা ছাড়াও ‘গোল্ডেন গ্লাভস’ জিতে নিয়েছিলেন নয়্যার। সেই সাথে বুন্দেসলিগা, ক্লাব বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, জার্মান ঘরোয়া লিগের নানান শিরোপা দিয়ে সুসজ্জিত তাঁর অর্জনের ক্যাবিনেট।

তবে একটা আক্ষেপের জায়গা রয়ে গিয়েছে। সে জায়গাটা অবশ্য উয়েফা ইউরো জিততে না পারার আক্ষেপ। জাতীয় দলের হয়ে ইউরোপ সেরা হওয়ার গৌরবটা ঠিক অর্জন করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তবে সুযোগ যে নেই তা নয়। ২০২৪ সালে শিরোপা জয়ের সুযোগ রয়েছে তাঁর সামনে। হয়ত তিনি শেষ সুযোগটা হাতছাড়া হতে দেবেন না।

জার্মানি সব সময়ই বিশ্বমানের সব গোলরক্ষক উপহার দিয়ে আসছে গোটা ফুটবল দুনিয়াকে। ওলিভার কান, জেন্স লেহম্যান, সেপ ম্যাইয়ারদের ধারাটা ধরে রেখে নয়্যার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জার্মান ফুটবলের গোলরক্ষকদের ‘লিগ্যাসি’। তিনি বনে গেছেন ইতিহাস সেরাদের একজন। অর্জন আর পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে তিনি ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link