শচীন-ওয়ার্ন, অমর সেই লড়াই

৭০৮ নেহায়েত এক সংখ্যা মাত্র। তবে একটা মানুষে পুরো একটা টেস্ট ক্যারিয়ারে এই সংখ্যাটার মাহাত্ম বলে শেষ করবার নয়। মানুষটা শেন ওয়ার্ন। ক্রিকেটে বনেদী ফরম্যাটে তিনি নিয়েছিলেন‘ গুণে গুণে ৭০৮ খানা উইকেট। হাজারের মধ্যে এক সংখ্যা তবুও এর পেছনের পরিশ্রম তো আর কম নয় কিংবা ত্যাগের গল্পও তো বলে শেষ করা যাবে না।

এই ২০২২ এর মার্চে তিনি সকল ত্যাগের অবসান ঘটিয়ে দেহত্যাগ করে চলে গেলেন দূরদেশে। স্মৃতির মায়াজালে সবাইকে জড়িয়ে রেখে গেলেন। কি দূর্দান্ত এক সময় তিনি পার করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। কতশত খেলোয়াড়ের রাতের ঘুম হারাম করেছেন তাঁর হিসেব বের করাটা বেশ কষ্টসাধ্য এক কাজ। দারুণ এক দ্বৈরথ ছিল তাঁর আর শচীন টেন্ডুলকারের মধ্যে।

তাঁদের দু’জনের সে দ্বৈরথ নিয়ে সম্প্রতি শেন ওয়ার্নকে ঘিরে আয়োজিত হওয়া স্মরণসভায় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলর স্মৃতিচারণ করেন। তিনি শচীন আর ওয়ার্নের মধ্যকার হওয়া মানসিক এবং ক্রিকেটীয় লড়াইয়ের এক ঘটনা তুলে ধরেছিলেন টেলর।

ঘটনাটা ১৯৯৮/৯৯ মৌসুমের। ভারতে টেস্ট খেলতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। উপমহাদেশ বরাবরই স্পিন স্বর্গ। সেখানে আবার খেলতে আসছেন স্পিন জাদুকর। মনের গহীন কোণে কিঞ্চিত দুশ্চিন্তা ভর করা স্বাভাবিক। তবে দুশ্চিন্তা না করে বরং সেবার ওয়ার্নকে সামলানোর ভিন্ন পরিকল্পনার ছক কষে ফেলেছিল শচীন। শুধু ছক কষেই ক্ষান্ত হননি। পরিকল্পনামাফিক বাড়তি অনুশীলনও করেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলর এ বিষয়ে বলেন, ‘গণমাধ্যমে বেশকিছু খবর এসেছিল যে ওয়ার্নকে সামলাতে বাড়তি ঘাম ঝড়াচ্ছে শচীন।’

তবে, ভাবুন একবার। ভারতের সেরা ব্যাটার আলাদা করে ভাবতেন কি করে শেন ওয়ার্নকে খেলা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে কি করে টিকে থাকা যায় বাইশ গজ কাল মাটিতে। ইতিহাস সেরা একজন যখন সমীহ করেন আরেকজন ইতিহাস বিখ্যাত খেলোয়াড়কে তখন আর বাড়তি শব্দের প্রয়োজন হয় না।

তবে অস্ট্রেলিয়ার সেবারের সফরে বেশ ভাল এক দ্বন্দ হয়েছিল শচীন আর ওয়ার্নের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়া প্রস্তুতি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল মুম্বাইয়ের একাদশের বিপক্ষে। তখনকার অজি অধিনায়ক টেলরকে অবাক করেছিল একটি বিষয়। শচীন টেন্ডুলকার সে ম্যাচটা খেলেছিল মুম্বাই একাদশের হয়ে। মূল দলের একজন খেলোয়াড় প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে চলে এলে খানিক ভ্রু কুচকে যাওয়া স্বাভাবিক।

তবে টেলর সেদিন ওয়ার্নকে বলেছিলেন, ‘শচীন মাঠে নামার সাথে সাথে আমি তোমাকে বল করতে পাঠাব’ তাই করেছিলেন টেলর। তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। টেলর বলেন, ‘আমি ওয়ার্নিকে (শেন ওয়ার্ন) বোলিংয়ে নিয়ে আসলাম। তবে কাজ হয়নি টেল্ডুলকার ওয়ার্নিকে মাঠের চারপাশে খেলে ১৮০ রান করে ফেলেছিল।’ এখানে শচীন যেন মানসিক দ্বৈরথ জয় করে নিলেন।

তবে টেলর বিশ্বাস করতে চান সেবার ওয়ার্ন তাঁর সবটুকু দিয়ে বোলিং করছিলেন না। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে আমার মনে হয়না ওয়ার্নি তাঁর সর্বোচ্চটুকু দিচ্ছিলেন।’

হয়ত, কেননা একটা প্রস্তুতি ম্যাচে নিশ্চয়ই কেউ তাঁর পূর্ণ শক্তিমত্তা প্রদর্শন করবে না। তবে মূল ম্যাচে তাঁদের সেই দ্বৈরথের আসল চিত্রপট সামনে চলে আসে। চেন্নাইয়ের প্রথম টেস্টে ভারত বিপাকে পড়ে যায় ষাটের কাছাকাছি রানে দুই উইকেট হারিয়ে।

তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামলেন শচীন টেন্ডুলকার। পরমুহূর্তেই টেলর জানিয়ে দেন ওয়ার্নকে আসতে হবে বোলিংয়ে। এলেন বোলিং করতে শেন ওয়ার্ন। মূল ম্যাচে শচীন ও ওয়ার্নের সে লড়াইয়ের বিবরণ দিয়ে টেলর বলেন, ‘প্রথম বল, ডাউন দ্য ট্র্যাকে এসে সোজা ওয়ার্নের মাথার উপর দিয়ে চার মেরে দেয় শচীন। দুই বল বাদে আবার বল করল ওয়ার্নি। বলটা খানিক লাফিয়ে উঠলো। কভার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে শচীন টেল্ডুলকারের ব্যাটে খোঁচা লেগে বল জমা পড়ে প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা আমার হাতে। শচীন সে চার রানেই আউট হয়ে গেল।’

এ দফায় লড়াইটা জিতে নেন ওয়ার্ন। তবে টক্করটা যে দুই মহারথীর মাঝে। অল্পতেই কি আর থেমে যাবে? না হয় নাকি। শচীন ঘুরে দাঁড়ালেন দারুণভাবে। ১৫৫ রানে ছিলেন তিনি অপরাজিত। এই না তবে দুই সেরার লড়াই!

শচীনের সেদিনের সেই অনবদ্য ইনিংস নিয়ে টেলর বলেন, ‘আবার শচীন ব্যাট করতে এলো আর আমি ওয়ার্নিকে বললাম তুমি বোলিংয়ে যাচ্ছো। আবারও ওয়ার্নির মাথার উপর দিয়ে চার হাঁকিয়ে নিল শচীন। ওয়ার্নি ক্রিজের অপর প্রান্ত থেকে বল করে পিচে পড়া পায়ের ছাপ টার্গেট করে বল করবে বলে আমাকে।’

তবে সে পন্থাতেও খুব একটা কাজ হয়নি, টেলর বলেন, ‘তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বলে স্লগ-সুইপ করে ওয়ার্নিকে ছক্কা হাঁকায় শচীন। ওভার শেষে ওয়ার্নি আমাকে জিজ্ঞেস করে এখন আমরা কি করবো। আমি শুধু বলেছিলাম এখন আমরা হারব।’

হ্যাঁ সেদিন শচীনের অপরাজিত ১৫৫ রানের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়াকে ১৭৯ রানে হারিয়েছিল ভারত। যদি শচীন আর ওয়ার্নের লড়াইয়ের অনুপাত বের করি তবে অনুপাতটা দাঁড়ায় ১:১। বাদ যাচ্ছে প্রস্তুতি ম্যাচের হিসেব নিকেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link