২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের খেলা অতিমানবীয় ইনিংস টির কথা মনে আছে? কিংবা রিকি পন্টিংয়ের ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা বিধ্বংসী ইনিংসটি এখনো কি মনের পর্দায় ভাসে? নিজ দেশের কিংবদন্তিদের এমন অর্জনকে আরেকবার সামনে নিয়ে আসার জন্য হয়তো আইসিসির নারী বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চকে বেছে নিয়েছিলেন আরেক অজি ব্যাটসম্যান এলিসা জিন হিলি। একাই রীতিমতো ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলেন তিনি।
২০২২ সালের আগে সর্বশেষ চার বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই ফাইনালের লড়াইয়ে নেমেছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। দুইবার করে জিতেছিল দুই দলই। তাই আরেকটি সমানে-সমানে লড়াই দেখার অপেক্ষায় ছিল ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু তা আর হলো কই। এলিসা হিলি’র তাণ্ডবে প্রায় এক তরফা ভাবেই শিরোপা জিতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেই সাথে নিশ্চিত করলো নিজেদের সপ্তম বিশ্বকাপ শিরোপা।
টসে জিতে কিউই অধিনায়ক যখন ব্যাট করতে পাঠিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া-কে তখন নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি কি ঘটতে চলেছিল। পুরো টূর্নামেন্ট জুড়েই ফর্মে থাকা অজি ওপেনিং জুটি আজকেও দলকে এনে দেন উড়ন্ত সূচনা। দুই ওপেনার অ্যালিসা হিলি এবং হেয়নেস শুরুর পাওয়ারপ্লে-তে ধীরে সুস্থে ব্যাটিং করলেও এরপর থেকেই রানের গতি বাড়াতে থাকে এ দুইজন।
প্রথম দশ ওভারে মাত্র ৩৭ রান তুললেও পরে মাত্র ২৭.১ ওভারেই দলীয় ১৫০ রানে পৌছায় টিম অস্ট্রেলিয়া। এরপর অবশ্য ইনিংস বড় করতে পারেননি হায়নেস। দলীয় ১৬৯ রানে ইংলিশ বোলারদের প্রথম উদযাপনের মূহুর্ত এনে দেন। হায়নেস ফিরেন ৬৮ রান করে। সঙ্গী ফিরে গেলেও একমূহুর্তের জন্যও থামেননি অ্যালিসা। বেথ মুনি-কে সাথে নিয়ে গড়েন ১৫৬ রানের আরেকটি ম্যারাথন জুটি। এরপর এলিসা ফিরলেও ততক্ষণে রেকর্ড বইয়ে ঝড় উঠে গিয়েছে।
পুরুষ কিংবা নারী, এর আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে যা আগে কেউই করে দেখাতে পারেনি তাই করে দেখিয়েছেন অ্যালিসা হিলি। আউট হওয়ার আগে মাত্র ১৩৮ বলে ১৭০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এর আগে ২০০৭ সালে পুরুষ বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৪৯ রান করে বিশ্বকাপের যেকোনো আসরের ফাইনালে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। হিলি গড়েছেন রেকর্ড আর গ্যালারি থেকে উপভোগ করেছে তারই জীবনসঙ্গী মিশেল স্টার্ক।
ইংল্যান্ডের জন্য লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালো ৩৫৬ রান। রান যখন এত বড়, তখন অস্ট্রেলিয়ার জয়টাও অনুমেয়ও ছিল। হয়েছেও তাই; ন্যাট স্কাইভারের অপরাজিত ১৪৮ রানের পরেও ৪৩.৪ ওভারে ২৮৫ রানে গুটিয়ে যায় ইংলিশরা। অবশ্য উইকেট হাতে থাকলে হয়তো কিছু একটা ঘটেও যেতে পারতো। অজি বোলার জোনাসেন এবং অ্যালানা কিং দুজনেই নিয়েছেন তিনটি করে উইকেট।
এলিসা হিলির ১৭০ রান পুরুষ-নারী মিলে যেকোনো বিশ্বকাপের ফাইনালেই সর্বোচ্চ। ১৭০ রান করার পথে হিলি গড়েছেন আরও কিছু রেকর্ড; হেয়নেসকে নিয়ে গড়েছেন ফাইনালে সর্বোচ্চ ১৬০ রানের জুটি, ৫০৯ রান করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় সবার ওপরে নাম লিখিয়েছেন হিলি। ম্যান অব দ্য ফাইনালের পাশাপাশি ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টও হয়েছেন অজি ব্যাটার হিলি।
রান বন্যার এই ম্যাচে শেষ হাসিটা অস্ট্রেলিয়ার। পুরো টুর্নামেন্টেই দাপট দেখিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। বিশ্বকাপে খেলা সবচেয়ে সেরা দল নিশ্চয়ই বর্তমান অস্ট্রেলিয়ার দলটি; এমন পারফরম্যান্স এর পর অবশ্য সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকে না।
বিশ্বকাপ শিরোপা যখন উঁচিয়ে ধরছিল অজিরা, অন্যপাশে ইংলিশ অভিজ্ঞ বোলার আনা স্রাবসোল তাকিয়ে দেখছিলেন। ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে তিনিই তো নায়ক ছিলেন, আজ মঞ্চের বিপরীত দিকে। আর তার সতীর্থ ন্যাট স্কাইভার তো চোখের জল আটকাতে পারে নি।
১২১ বলে ১৪৮ রানের দুরন্ত এক প্রদশর্নী হয়তো কোনদিনই মনে থাকবে না কারো; দ্বিতীয়-কে তো কেউই মনে রাখে না। ক্রিকেটটাই এমন, চাইলেও যে অ্যালিসা হিলি আর ন্যাট স্কাইভার দু’জনকে বিজয়ের মালা একসাথে পরানো যাবে না, অথচ দুজনই বিজয়ী।