আজন্ম আগ্রাসনের অগ্রনায়ক

ক্রিকেটে ‘বল’ নামক চর্মগোলকটার সৃষ্টি কেন জানেন? এক কথায় উত্তর, পেটানোর জন্য। না, আমার কথা নয় এটি। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম নামক দোর্দন্ড প্রতাপে, নির্দয়-কঠিন ভাবে বল-পেটানো এক ব্যাটসম্যানের কথা। কি ভাবছেন, ম্যাককালামের সাথে আমার আবার দেখা হলো কখন! কথা হলো কখন?

ক্রিকেটে ‘বল’ নামক চর্মগোলকটার সৃষ্টি কেন জানেন? এক কথায় উত্তর, পেটানোর জন্য। না, আমার কথা নয় এটি। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম নামক দোর্দন্ড প্রতাপে, নির্দয়-কঠিন ভাবে বল-পেটানো এক ব্যাটসম্যানের কথা। কি ভাবছেন, ম্যাককালামের সাথে আমার আবার দেখা হলো কখন! কথা হলো কখন?

আরে ভাই, এই কথার উত্তর জানার জন্য তাঁর সাথে আমার দেখা করার দরকার আছে, না আমার নিউজিল্যান্ড যাওয়ার দরকার আছে? বলটাকে যে ধরণের দয়া মায়াহীন ভাবে পিটিয়ে ছাঁতু করেন, তাতে বলের যদি কথা বলার শক্তি থাকত তাহলে সে নির্ঘাত ম্যাককালাম কে লাখ-খানেক অভিশাপ অবধারিতভাবেই দিয়ে ফেলত এতদিনে! কী, দিত না?

পুরো নাম ব্রেন্ডন ব্যারি ম্যাককালাম। ত্রিশের আশেপাশে ওয়ানডে গড় ও আটত্রিশের টেস্ট গড় দেখে আপনি যদি ম্যাককালাম-কে বিচার করতে যান, তাহলে আপনি ভয়ংকর ভুল করবেন। ম্যাককালাম-কে বিচার করতে হলে আপনাকে দেখতে হবে গোটা একটি যুগের বোলারদের নিদ্রাহরণকারী একজন ব্যাটসম্যানকে। শন টেইটের দেড়শো কিমির গোলাকেও যিনি অনায়াসে স্কুপ করেছিলেন। বোলারদের সমস্ত দর্প-চূর্ণ করে যিনি শুধু জানতেন, বলটাকে তাঁর সীমানা ছাড়া করতে হবে। পিচ, কন্ডিশন, ঘূর্ণন, সুইং, বাঁক, গতি, পঞ্চম দিন কি প্রথম দিন ম্যাককালামের জন্য এসবের কোন কিছুই মাথাব্যাথার কারণ নয়। তাঁর কেবল ও কেবলমাত্র চিন্তা হলো, বলটাকে পিটিয়ে কিভাবে সীমানা দড়ির ওপারে নেয়া যায়!

যুগ-আনন্দ সঞ্চারী বলতে যা বোঝায়, ম্যাককালাম ছিলেন তা-ই। গত এক যুগ ধরে আনন্দ-ই সঞ্চারণ করে গিয়েছেন কেবল। ব্যাটিং ব্যকরণের সমস্ত শিক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন বারংবার। পেশী শক্তি ব্যবহারেরও যে একটা নান্দনিক ভঙ্গি আছে, ম্যাককালামের ব্যাটিং তা আপনাকে ভালভাবেই বুঝিয়ে ছাড়বে। আঁটসাঁটও ফিল্ডিংকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, হাঁসফাঁস অবস্থা কে এক মূহুর্তে বিলীন করে দিয়ে ম্যাককালাম আপনাকে দেবে চার-ছক্কার নিখাঁদ বিনোদন। ম্যাককালাম কি করতে পারবেন বোঝা না-গেলেও, কি করবেন তা ছিল যথেষ্ট অনুমেয়। চোখের সামনে এসে পড়ার অপরাধে বলটাকে তেড়েফুঁড়ে করবেন আক্রমণ!

শুধুই কি ব্যাটসম্যান ম্যাককালাম এত বিনোদন দিয়েছেন? তাহলে আপনার ম্যাককালাম কে দেখা হয়নি এখনো পুরোটা! ক্যাপ্টেন ম্যাককালাম যে ছিলেন আরও আগ্রাসী আরও বিধ্বংসী! প্রচলিত ধরা বাঁধা নিয়মকে ভেঙ্গে তছনছ করে, গুড়িয়ে দেয়াতেই যেন তাঁর তৃপ্তি। তাঁর আনন্দ।

স্ট্রাইক বোলারকে একটানা দশ ওভার বোলিং করাতেও তিনি যেমন পিছপা হন না, তেমনি ওয়ানডেতেও টানা স্লিপ বসিয়ে রাখতে যেন তাঁর কোন ক্লান্তি নেই! ব্যাটিংয়ে নেমেই যেমন বিপক্ষ দলের এ টু জেড যত প্ল্যান সব ভেস্তে দিতে তিনি সিদ্ধহস্ত, ঠিক তেমনি অধিনায়ক হিসেবেও দেন না এতটুকু ছাড়! তাঁর ক্যাপ্টেন্সিতে আর কিছু থাক না-থাক, আগ্রাসন যেন থাকবেই।

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কে আপনি ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বললেও খুব বেশী বাড়িয়ে বলা হয় না। রাগবির দেশ নিউজিল্যান্ডেও তিনি যে, ক্রিকেট-রোমাঞ্চ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন তা তো ঐ ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বলেই। পূর্বসূরি হ্যাডলি, ফ্লেমিং, ভেট্টরীরা যা পারেননি, তিনি তা পেরেছেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে তো তুলেছেন-ই, তার চেয়েও বড় ব্যাপার নিউজিল্যান্ডের কিশোর প্রজন্মের মাঝে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটের অমৃত সুধার বীজ! তাই ফ্লেমিং, ভেট্টোরি, হ্যাডলিরা পরিসংখ্যানে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও, ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় পেছনে পড়ে যান অনেকটা ব্যবধানেই। সাইমন ডৌল, ড্যানি মরিসনদের আবেগঘন গলা বারবার কেঁপে উঠেছে, ম্যাককালামের কথা বলতে গিয়ে। কারণ, ঐ ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হয়তো!

মানুষ ম্যাককালাম কে একটু চিনবেন না? যিনি মরুর শারজায় তুলেছিলেন ভয়ংকর ঝড়! যে ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল সে বছর মধ্যপ্রাচ্যে দুর্দান্ত দাপট দেখানো পাকিস্তানও। শারজা টেস্টে করেছিলেন, ডাবল সেঞ্চুরি। এ তো সেই ব্যাটসম্যান ম্যাককালামই হয়ে গেল!

না, হয়নি।

কারণ, এই ঝড় তোলার পেছনের কাজ করেছিল, ‘ফিলিপ হিউজ’ নামক এক তরুণের মৃত্যুশোক! হিউজের প্রতি নিবেদন দেখাতে গিয়ে ম্যাককালাম সেদিন পাকিস্তানি বোলারদের উপর কি চড়াও-ই না হয়েছিলেন! আগ্রাসনের পুরোটা ক্রিকেট মাঠে রেখে এসে, আপাদমস্তক ভদ্রলোকটি আপনাকে জানাবে মানুষ ম্যাককালাম কেমন!

তিনি জীবনের শেষ টেস্টেও করেছিলেন, ৭৯ বলে ১৪৫! টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৫৪ বলে সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড! যাওয়ার আগে আরও একবার দেখিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ‘মাসল’ পাওয়ার, তাঁর ব্যাটিং সক্ষমতা। ২৭ ওভারে ৭৪ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা দলটাই পরের ১৮ ওভারে তুলেছিল ১৭৯! যাতে ম্যাককালামেরই ছিল ৭৯ বলে ১৪৫!

তাঁর অবসর-কালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর ধারে-কাছে ছিল না, কেউই। ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটের ‘কিংবদন্তী’-ই বলা চলে তাকে! তবু তিনি ক্রিকেট-রোমাঞ্চিকদের মনে থাকবেন হয়তো, তাঁর বাঁধনহারা আগ্রাসনের জন্যই। তাঁর ক্যাপ্টেন্সির জন্যই। ইমরান-স্টিভ-রানাতুঙ্গাদের পর তিনি যে ক্রিকেটে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই ‘ক্যাপ্টেনস গেম’ কথাটা!

নান্দনিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত মাত্রা স্পর্শ করে, ক্রিকেটকে দিয়েছিলেন অদ্ভুত এক সৌন্দর্য্য! সব নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে, তাঁর মত করেই গেয়েছেন আগ্রাসনের জয়গান। তাই ম্যাককালাম মানেই যেন আগ্রাসন! সে ব্যাটিং-ই হোক, কিংবা ক্যাপ্টেন্সি! আগ্রাসন, আগ্রাসন এবং আগ্রাসন, এ-ই ছিল তাঁর দর্শন।

১৯৮১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ডানেডিনে জন্মেছিলেন তিনি। ২০১৬-এর শুরুর দিকে স্বদেশে অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে টেনেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সমাপ্তি। চাইলে হয়তো আরও বছরখানেক খেলে যেতে পারতেন। হয়তো বল নামক চর্মগোলকটিকে একটু তাড়াতাড়ি রেহাই দিতে চেয়েছিলেন, তাই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে শেষ বলে দিয়েছিলেন মধ্য-পঁয়ত্রিশেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link