যুদ্ধের মঞ্চে বেঁচে থাকা ক্রিকেট স্বপ্ন

আপনি কি ওয়েন চেককে চেনেন? যদি না চিনে থাকেন তবে আমি নিশ্চিত আপনি এটাও জানেন না যে ইউক্রেনের একটি জাতীয় ক্রিকেট দল রয়েছে। না জানাটা খুব স্বাভাবিক। ইউক্রেন ক্রিকেট খুব বেশি আলোচিত নয় কিংবা পরিচিতও না। এমনকি খোদ ইউক্রেনে ক্রিকেটটা খুব একটা জনপ্রিয় নয়।

২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র উপমহাদেশ থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সেখানে ক্রিকেট খেলতেন। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। জাতীয় দলও একটা গঠন করা হয়েছিল সে দলেরই ওপেনার ওয়েন চেক। চেকের অবশ্য আরও এক পরিচয় রয়েছে। তিনি ইউক্রেন ক্রিকেট ফেডারেশনের একজন সহ সভাপতি। তবে চেক পুরোদস্তুর একজন ইউক্রেনিয়ান নন।

তিনি ১৯৯৩ সালে ১৭ বছরের এক কিশোর হিসেবে পা রেখেছিলেন ইউক্রেনে। এরপর তিনি ইউক্রেনেই থেকে যান। তবে ক্রিকেট ছেড়ে তিনি এখন পুরো মনোযোগী শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষদের সেবায়। যে দেশটা হয়ে তিনি আন্তর্জাতিকি স্বীকৃত ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন সে দেশটা তো আজ যুদ্ধের কালো থাবায় বিপর্যস্ত। সে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটায় তিনি মানব সেবায় নিজেকে সপে দিয়েছেন।

তবে তাঁদের এখন প্রস্তুতি নেওয়ার কথা মেডিটেরিয়ান ক্রিকেট লিগের জন্যে। এবারে গ্রীষ্মে তাঁদের সে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্যে ক্রোয়েশিয়াতে যাওয়ার কথা ছিল। তবে দৃশ্যপটে কি আমুল পরিবর্তন এনে দেয় সময়। চেকে আরেক সতীর্থ ইউরি জ্যাকরুস্কি ইউক্রেনের নাগরিক হওয়া সত্ত্বে তিনি ছাড়তে পারবেন না দেশ। কেননা ১৮-৬০ বছর বয়সী ইউক্রেনিয়ান পুরুষদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

অন্যদিকে ইউক্রেন জাতীয় দল ঘটন করা হয়েছিল অধিকাংশ উপমহাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে। যাদের অধিকাংশই হয় চাকরি কিংবা শিক্ষাসূত্রে বসবাস করতেন ইউক্রেনে। তাঁদের অধিকাংশই এখন অবস্থান করছেন নিজেদের দেশে। তাঁদের কারও পক্ষেই আসলে এখন একটি দল হয়ে খেলার সময় কিংবা সুযোগ অথবা মানসিক পরিস্থিতি নেই। যুদ্ধের মাঝে আর যাই হোক ক্রিকেট খেলাটা হয় না।

তবে এতে করে আরও খানিকটা পিছিয়ে গেল ইউক্রেনের ক্রিকেট। আইসিসির বার্ষিক সভায় ইউক্রেন সদস্যপদ লাভের প্রত্যাশা করছিল। তবে সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই দোলাচলের শেষ নেই ইউক্রেন ক্রিকেট ফেডারেশনের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা কবুস অলিভার। তিনি হয়ত এটা বিশ্বাস করেন যে এ দফা না হলে আর কখনোই হয়ত ইউক্রেনের আইসিসি সদস্য হওয়া হবে না।

অলিভার আপ্রাণ খেটে যাচ্ছেন ইউক্রেন ক্রিকেটের উন্নয়নে। তিনি ২০১৮ সালে ইউক্রেনে গিয়েছিলেন একজন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে। তবে যেহেতু তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান এবং সেখানে ক্রিকেটও খেলেছিলেন পেশাদার পর্যায়ে তিনি ক্রিকেট নামক গাছটির পরিচর্যা করতে চেয়েছিলেন ইউক্রেনের মাটিতেও। তবে বীজটা তিনি বপন করেননি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইউক্রেন ক্রিকেট ফেডারেশন।

অলিভার ক্রিকেটকে ইংরেজি শেখার এক মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ক্যারিকুলামে যুক্ত করেন। এরপর থেকেই তিনি ক্রিকেটে কাঠামো ঠিক করতে নেমে পড়েন। যেহেতু ক্রিকেটের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল আগে থেকেই এবং তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা, দুবাই, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের, কেনিয়ার মত জায়গায় ক্রিকেটের সাথে বিভিন্ন ভাবে যুক্ত থেকেছেন ও কাজ করেছেন। তাই তিনি অভিজ্ঞ এক সেনাপতি ছিলেন ইউক্রেন ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে।

তিনি সে কাজটাই করার লক্ষ্যে যুব উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি প্রত্যাশা করছিলেন যে আগামী পাঁচ-সাত বছরের মাঝেই পুরো ইউক্রেনের খেলোয়াড়দের দিয়ে জাতীয় দল গড়তে পারবে দেশটি। সেটা স্বপ্নটা নিশ্চয়ই পিছিয়ে গেল বহু বছরের জন্যে। তবে অলিভার কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি যেন এক নাছোরবান্দ। তিনি আইসিসির সদস্যপদটা যেন নিয়েই ছাড়বেন।

তাইতো তিনি ক্রোয়েশিয়া থাকা শরণার্থী শিবিরে ক্রিকেটের আলোড়ন সৃষ্টি করতে চাইছেন। যেহেতু শরণার্থী শিবিরে থাকা অধিকাংশই শিশু তাই তিনি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছেন। আইসিসির সদস্যপদ পাওয়ার সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে যুব উন্নয়নের কার্যক্রম পরিচালনা করা। সে কাজটা শরণার্থী শিবিরেই চালিয়ে যেতে চান অলিভার। আর তাছাড়া তিনি আইসিসির আরেক সদস্য ক্রোয়েশিয়ার সহয়তাও নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্রোয়েশিয়া আইসিসির সদস্য সেই ২০০১ সাল থেকে।

অন্যদিকে অন্যদেশে চলে যাওয়া ইউক্রেনের জাতীয় দলের হয়ে খেলা ক্রিকেটাররাও নিজেদের প্রস্তুত রাখছেন যে কোন মুহূর্তে দলটির হয়ে ক্রিকেটের ময়দানে ফেরার জন্যে। তেমনই একজন ফয়সাল কাসিম, ভারতীয় ক্রিকেটার খেলতেন ইউক্রেন জাতীয় দলের একজন পেসার হিসেবে। তিনি টানা পাঁচ দিন কাটিয়েছেন বাঙ্কারে। যুদ্ধের সে ভয়াবহতা ভুলে তিনি ঠিকই আবার ফিরেছেন ক্রিকেটে।

খেলছেন স্থানীয় টেপ টেনিস টুর্নামেন্টগুলো। তাছাড়া তিনি নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে নিয়মিত অনুশীলনও করে যাচ্ছেন। যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মাঝেও বিশ্বক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দেড়ানোর একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আফগানিস্তান। আরও একটি উদাহরণ কি ক্রিকেটে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারবে কি না সে অপেক্ষা আমাদের করতেই হচ্ছে। ক্রিকেটের সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে যাক সর্বত্র। বারুদ ফুটুক বাইশ গজে, বল আর ব্যাটে হোক লড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link