২৬ মে, ২০১৮; ইউক্রেনের কিয়েভ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোলরক্ষক লরিস ক্যারিয়াসের শিশুতোষ ভুলে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সেদিন দাঁড়াতেই পারেনি লিভারপুল। ৩-১ গোলে জিতে যায় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা, যার দুইটিতেই ছিল অলরেড গোলরক্ষকের অবদান। নিজ দলের এমন একতরফা পরাজয় অবশ্য মাঠে থেকে দেখতে পারেননি দলের সেরা তারকা মোহামেদ সালাহ। ম্যাচের তেরো মিনিটের মাথায় রিয়াল অধিনায়কের সাথে বল দখলের লড়াইয়ের সময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে আহত হয়েছিলেন এই উইঙ্গার।
বাধ্য হয়ে মাঠ থেকে উঠে যেতে হয়েছিল তাকে। এই ইনজুরির কারণেই পরবর্তীতে রাশিয়া বিশ্বকাপেও ফর্মে ছিলেন না মো সালাহ। তাই হয়তো সবসময়ই চেয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের সাথে আবার দেখা হোক, পুরোনো হিসাব মিটিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ হোক। ফুটবল বিধাতা তার আবদার মেনে নিয়েছে, আবারো একই মঞ্চে দেখা হতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ আর লিভারপুলের।
২০১৮ এর সেই দু:সহ স্মৃতির চার বছর পর ফ্রান্সের প্যারিসে আবারো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ অলরেডরা। এমন ম্যাচে মাঠে নামতে মোহামেদ সালাহও তাই উদগ্রীব হয়ে আছেন। সরাসরিই বলে দিয়েছেন রিয়ালের বিপক্ষে প্রতিশোধ নিতেই মাঠে নামবেন মিশরীয় তারকা। কাকে ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে চান, এমন প্রশ্নে যেমন বলেছেন স্প্যানিশ জায়ান্টদের নাম তেমনি রিয়াল ফাইনাল নিশ্চিত করার পরেই তিনি টুইট করেছিলেন, ‘We have a score to settle.’
অবশ্য প্রতিশোধের মন্ত্র আওড়াতে পারে রিয়াল মাদ্রিদও। কারনটা জানতে একটু পিছনেই যেতে হবে। মাদ্রিদের ক্লাবটি তাদের সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল হেরেছিল ১৯৮১ সালে। এই লিভারপুলের বিপক্ষেই সেবার হেরে গিয়েছিল তারা। কাকতালীয়ভাবে সেই ফাইনালটিও হয়েছিল প্যারিসেই। এরপর অবশ্য টানা সাতটি ইউরোপীয় ফাইনালে হারেনি টুর্নামেন্টের সফলতম ক্লাবটি।
দুই দেশের দুইটি সেরা ক্লাবের এই দ্বৈরথে অতীত স্মৃতি ফিরতে পারে রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি’র মনেও। ২০০৫ সালে এসি মিলানের বিপক্ষে লিভারপুলের অবিশ্বাস্য কামব্যাকের কথা ভক্তদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেইদিন ইতালিয়ান ক্লাবটির ডাগআউটে ছিলেন স্বদেশি কার্লো। আর তাই মুখে না বললেও তিনি চাইবেন লিভারপুলকে হারিয়ে পুরোনো ক্ষতে প্রলাপ দিতে।
ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ে ফেভারিট কে – এমন প্রশ্নে অধিকাংশ ফুটবল বিশ্লেষক বেছে নিয়েছেন লিভারপুলকে। কারনটা জানাই আছে, ম্যানচেস্টার সিটি কিংবা পিএসজি’র বিপক্ষে নব্বই মিনিটের মাঝে রিয়াল মাদ্রিদ আসলে খেলেছে পনের বিশ মিনিট। তবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এতটুকু যথেষ্ট ছিল অল হোয়াইটদের জন্য। তবু কমপ্লিট ফুটবল খেলে ফাইনালে কোয়ালিফাই করা ইংলিশ ক্লাবটিকেই এগিয়ে রাখছেন অনেকে। অবশ্য বেনফিকা, ভিয়ারিয়ালের মত তুলনামূলক খর্ব শক্তির দলকে হারিয়ে আসা লিভারপুল কতটা ফেভারিট সেটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।
দুই দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে মাঠে নামে, তখন তা ফুটবলবোদ্ধা থেকে শুরু করে সমর্থকদের নজর কাড়বে তাই স্বাভাবিক। তার উপর মঞ্চটি যদি হয় উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল, তাহলে তো পুরো বিশ্বেরই মনোযোগ থাকবে ধ্রুপদী এই লড়াইয়ে। এর আগে দুইদলের মুখোমুখি দেখা হয়ে ছিল আটবার। যেখানে একবার ড্র হলেও বাকি চারবার জয়ের হাসি হেসেছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং বাকি তিন ম্যাচে জয়ীদলের নাম লিভারপুল। এছাড়া লিভারপুলের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ গোল করেছে সর্বমোট ১০টি এবং লিভারপুল তাদের জালে বল জড়িয়েছে ৮ বার।
সাম্প্রতিক ফর্মের ক্ষেত্রেও দুইদলই আছে স্বস্তির জায়গায়। রিয়াল মাদ্রিদ তো লা লিগা চ্যাম্পিয়ন, অন্য দলগুলোর সাথে বেশ বড় রকমের ব্যবধানে লিগ শিরোপা জেতা লস ব্ল্যাঙ্কোসরা তাই আত্মবিশ্বাসী হয়েই মাঠে নামবে। অন্যদিকে প্রিমিয়ার লিগে রানার আপ হলেও লিভারপুল এবারের মৌসুমে নব্বইয়ের বেশি পয়েন্ট জিতেছে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সর্বশেষ ১৭টি ম্যাচ অপরাজিত অলরেডরা।
অন্য সবসময়ের মত ফাইনালেও লিভারপুলের সম্ভাব্য ফরমেশন ৪-৩-৩। ডাচ সেন্টারব্যাক ভার্জিল ভ্যান ডাইকের উপরই দলটির প্রতিরক্ষার মূল দায়িত্ব। এছাড়া ডিফেন্সে তার সঙ্গী হতে পারেন দলটির নতুন ডিফেন্ডার ইব্রাহিম কোনাতে। অন্যদিকে, দুই ফুলব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসন আর ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার ডিফেন্সের পাশাপাশি আক্রমনেও প্রতিপক্ষের বড়সড় দুশ্চিন্তার কারন।
হোল্ডিং মিডফিল্ডারের পজিশনে ব্রাজিলিয়ান ফ্যাবিনহোর উপর ভরসা রাখবে লিভারপুল। এছাড়া মিডফিল্ডে অন্য দুইজন হতে পারেন অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন এবং থিয়াগো আলকান্ত্রা। তবে লিভারপুলের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তাদের আক্রমন ভাগ। মোহামেদ সালাহ তো আছেনই, আছেন আরেক আফ্রিকান তারকা সাদিও মানে। দুই অভিজ্ঞ সদস্যের পাশাপাশি তরুন লুইস দিয়াজ, দিয়েগো জোতারাও প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের পরীক্ষা নিতে প্রস্তুত।
অন্যদিকে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ মৌসুমের শুরু থেকেই পছন্দের ৪-৩-৩ ছকে খেলেছে। তবে দলটির দুশ্চিন্তার কারন ডিফেন্স লাইন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই ডিফেন্স নিয়ে ভাল রকমের সমস্যায় পড়তে হয় দলটিকে। আর তাই ফাইনালে সবটুকু দিয়ে লিভারপুলকে প্রতিরোধ করতে হবে মিলিটাও, আলাবাদের। এই দুইজন ছাড়াও ডিফেন্স লাইনে থাকবেন দানি কারভাহাল এবং ফারলান মেন্দি।
রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ড নিয়ে অবশ্য কোন সন্দেহ নেই। টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচের পাশাপাশি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পজিশনে আছেন ক্যাসেমিরো। তবে মৌসুমের শেষদিকে তরুন ফেদেরিকো ভালভার্দে কোচের পছন্দ হয়ে উঠেছেন আর তাই ফাইনালে অভিজ্ঞ তিন মিডফিল্ডারের পাশাপাশি এই উরুগুয়ানকে দেখা যেতে পারে একাদশে। সেক্ষেত্রে বল পায়ে ৪-৩-৩ ছকে থাকলেও, বল ছাড়া ৪-৪-২ ছকে দেখা যাবে অলহোয়াইটদের।
সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে এবারের মৌসুমে সবচেয়ে সফল রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগ। করিম বেনজেমা, ভিনি জুনিয়ররা অল্প একটু সুযোগ পেলেই উল্লাসের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন দলকে। ফাইনালের মহা ক্ল্যাশে তাই এই দুইজনের উপর চোখ থাকবে ভক্তদের। এছাড়া সেমিফাইনালের নায়ক রদ্রিগো কেও আবার জ্বলে উঠতে হতে পারে শিরোপা নির্ধারণী এই ম্যাচে।
প্লেয়ার টু ওয়াচের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয় লিভারপুলের মোহামেদ সালাহ আর রিয়াল মাদ্রিদের করিম বেনজেমার নাম। দুইজনেই এই মৌসুমের টপ পারফর্মার। ইতোমধ্যে ৪০ এর বেশি গোলের পাশাপাশি ১৫টি অ্যাসিস্ট করেছেন মাদ্রিদ অধিনায়ক। অন্যদিকে সালাহ’র নামের পাশে রয়েছে ৩১ গোল এবং ১৬টি অ্যাসিস্ট। আর তাই শিরোপার এই লড়াইয়ে দুইজনের পারফরম্যান্সই গড়ে দিবে মূল পার্থক্য। এছাড়া ভিনি জুনিয়র, লুইস দিয়াজের মত তরুনেরাও হতে পারেন ট্রাম্পকার্ড।
লস ব্ল্যাঙ্কোস শিবিরে ইনজুরি সমস্যা না থাকলেও লিভারপুলের জন্য মাথাব্যাথার কারন ইনজুরি। মিডফিল্ডের দুই কান্ডারী ফ্যাবিনহো এবং থিয়াগো’র খেলা এখনো নিশ্চিত নয়। এই দুইজন খেলতে না পারলে বড়সড় ঘাটতিই দেখা দিবে ইংলিশ ক্লাবটির মধ্যমাঠে। অন্যদিকে প্রায় মাস খানেকের বিরতি দিয়ে ইনজুরি থেকে ফিরেছেন ডেভিড আলাবা। রিয়ালের ডিফেন্সের মেইন ম্যান হবেন এই অস্ট্রিয়ান।
শুরুর সম্ভাব্য একাদশ
- লিভারপুল: অ্যালিসন, রবার্টসন, ভ্যান ডাইক, কোনাতে, আলেক্সান্ডার আর্নল্ড, হেন্ডারসন, ফ্যাবিনহো, থিয়াগো, সালাহ, মানে, দিয়াজ/জোতা।
- রিয়াল মাদ্রিদ: কোর্তোয়া, কারভাহাল, মিলিটাও, আলাবা, মেন্দি, ক্যাসেমিরো, টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচ, ফেদে ভালভার্দে/ রদ্রিগো, ভিনি জুনিয়র, বেনজেমা।
অতীত পরিসংখ্যান স্বস্তিই দিবে রিয়াল মাদ্রিদকে। হেড টু হেডে যেমন এগিয়ে আছে দলটি তেমনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসও প্রমান দেয় তাদের সামর্থ্যের। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যতবারই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নকে হারিয়েছিল ততবারই শিরোপা জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ।
এবারের মৌসুমেও চেলসিকে হারিয়েছে তারা; কে জানে, হয়তো শিরোপাটাও জিতে নেবে রিয়াল। এছাড়া সর্বশেষ সাতটি স্প্যানিশ বনাম নন-স্প্যানিশ ফাইনালে জিতেছে স্পেনের প্রতিনিধিরা। অবশ্য মাঠের খেলায় পরিসংখ্যানে কি আসে যায়, নব্বই মিনিটের খেলায় যার গোল বেশি হবে সে-ই হাসবে শেষ হাসি।
মাঠের লড়াইয়ের সাথে সাথে লড়াইটা হবে ডাগআউটেও। একদিকে জার্মান মাস্টারমাইন্ড ইয়ুর্গেন ক্লপ অন্যদিকে অভিজ্ঞ কার্লো আনচেলত্তি। ট্যাকনিক্যাল দিক দিয়ে ইয়ুর্গেন ক্লপ এগিয়ে থাকলেও কার্লো আনচেলত্তি এগিয়ে অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে। খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে এই নিয়ে সপ্তমবারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে খেলতে এসেছেন তিনি। আর ইয়ুর্গেন ক্লপ তো কয়েকদিন আগেই জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা ম্যানেজারের পুরস্কার।
প্রতিশোধের আগুনে উত্তপ্ত একটি ম্যাচ। রিয়াল মাদ্রিদ তাদের ১৪ তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতবে নাকি লিভারপুলের হাতে উঠবে সপ্তম ইউরোপীয় শিরোপা। ২০১৮ এর শোধ নিবে সালাহ নাকি তাকে আবারো হতাশায় ডুবিয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসবে মাদ্রিদ ভক্তরা? প্রতিশোধ নাকি প্রহসন, উত্তর জানা যাবে ২৮ মে রাত একটায়। ততক্ষণ পর্যন্ত না হয় হাতের কাজ গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকুন।