ব্যর্থদের মাদ্রিদ অধ্যায়

ইউরোপীয় দলবদলের মহাউৎসবে রিয়াল মাদ্রিদের অংশগ্রহণ থাকবে না, এমনটা যেন কল্পনাতীত। প্রায় প্রতিটা মৌসুমের দলবদলেই স্প্যানিশ ক্লাবটি চমকে দিতে সময় নেয় না। তারকা ফুটবলারদের সাদা পতাকাতলে নিয়ে আসার যেন কোন কমতি রাখতেই চাইতো না লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। তাতে অর্থকড়ি খরচ হোক। কার্পণ্য করা হবে না। এমনই ছিল মতাদর্শ।

সে মতাদর্শে সফলতাও তো কম মেলেনি, ক্রিশ্চিয়ানোর মত মহাতারকা থেকে শুরু করে কত তারকা ফুটবলাররাই তো মাতিয়েছেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। তবে প্রতিটি মুদ্রার দুইটি পিঠ থাকবেই। তারকারা যেমন সফল হয়েছে শুভ্র জার্সিতে, তেমনি ব্যর্থ হবার নজিরও কম নেই। আজকের আয়োজনটা তেমনই কিছু ব্যর্থতার ফিরিস্তি নিয়ে।

  • নিকোলাস অ্যানেলকা 

প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছিলেন নিকোলাস অ্যানেলকা। আর্সেনালের হয়ে নিয়মিত পারফরম করাদের একজন ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডে বেশ দাপট দেখানো এই স্ট্রাইকারকে রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের দলে পাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি।

তাইতো ১৯৯৯ সালে ৩৪.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। তবে ক্লাবের সাথে বনিবনা হয়নি তাঁর ঠিকঠাক। মাত্র এক মৌসুম স্পেনের রাজধানীতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ মেলে অ্যানেলকার।

  • অ্যান্টনিও ক্যাসানো

মাত্র পাঁচ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছিল ইতালিয়ান ক্লাব রোমা থেকে অ্যান্টোনিও ক্যাসানোকে দলে ভেড়াতে। তবে অধিকাংশের মত, সে অর্থের পুরোটাই জলে যায়। তিনি ছিলেন বড্ড বেশি উশৃঙ্খল।

আর তাছাড়া ক্লাবের হয়ে পারফরমেন্সও ছিল একেবারে শূন্যের কোটায়। তবুও প্রায় দুই মৌসুম তিনি ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। শুধুমাত্র নিজের পেছনে ক্লাবের অর্থখরচ যে একেবারেই অপচয় সেটা প্রমাণ করতে।

  • দানিলো

এই সময়ের রাইট ব্যাকে খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে দানিলো অন্যতম তরুণ একজন। সম্ভাবনাময় তিনি ছিলেন। তাইতো মাদ্রিদ একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের জন্যে ৩১.৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতেও দ্বিধা করেনি।

তবে, মাদ্রিদে এসে তিনি নিজের সম্ভাবনার ঝুলি থেকে তেমন কিছুই দিতে পারেননি। এর পেছনে অবশ্য দানি কার্ভাহালের অভাবনীয় পারফমেন্সও খানিকটা দায়ী। তবে পোর্তো থেকে আসা দানিলো পরবর্তীতে চলে যান ম্যানচেস্টার সিটিতে।

  • ইডেন হ্যাজার্ড

ইংলিশ ক্লাব চেলসির প্রাণভোমরা ছিলেন বেলজিয়ান তারকা ইডেন হ্যাজার্ড। ব্লুজদের সকল পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি ছিলেন। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেই রিয়াল মাদ্রিদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর ম্যাচের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারেন এমন এক খেলোয়াড় বড্ড প্রয়োজন ছিল মাদ্রিদের। তাইতো ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে হ্যাজার্ড গায়ে জড়ান সাদা জার্সি। তবে ইনজুরির বেড়াজালে নিজের সামর্থ্যের ছিটেফোঁটাও তিনি দিতে পারেননি মাদ্রিদকে। তবে এখনও তাঁর উপর ভরসা রাখছে ক্লাবটি।

  • লুকা জোভিচ

জার্মান ক্লাব এইন্ট্রাক্ট ফ্র্যাঙ্কফুটের হয়ে বুন্দেসলিগা দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন লুকা জোভিচ। তরুণ এই স্ট্রাইকার ফুটবল বিশ্বের পরবর্তী মহাতারকা হতে পারেন এমনটাই ধারণা ছিল সবার।

রিয়াল মাদ্রিদ এমন একজন খেলোয়াড়কে হাতছাড়া করতে চায়নি। ৬৬ মিলিয়ন ইউরোতে তাঁকে দলে ভেড়ায়। তবে আফসোস প্রত্যাশার খানিকটুকুও পূরণ করতে পারেননি জোভিচ। করিম বেনজেমার ছায়াতলে অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিলেন সাইড বেঞ্চে বসে।

  • কাকা

সম্ভবত মাদ্রিদ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আক্ষেপের নাম কাকা। ব্যালন ডি’অর জেতা এই তারকাকে দলে ভেড়াতে দলবদলের ইতিহাসে কাটাছেড়াও করে ফেলে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। ৬৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে তাঁকে মাদ্রিদের জার্সিটি পড়িয়ে দিতে।

নিজের ক্যারিয়ারের শীর্ষে থাকতেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাদ্রিদ শিবিরে। তবে ইনজুরি আর নানান রকম কারণে কখনোই প্রত্যাশার মশালের জ্বালানি হয়ে উঠতে পারেননি কাকা। এটাও বলা হয় যে তিনি তরুণ মেসুত ওজিলের কাছে হারিয়েছিলেন নিজের জায়গা।

  • রবার্ট প্রোসিনেস্কি

ঐশ্বরিক প্রতিভার অনেক উদাহরণ রয়েছে ফুটবলে। লিওনেল মেসি সেখানটায় অন্যতম। তবে রবার্ট প্রোসিনেস্কিও ছিলেন তেমনই একজন। সার্বিয়ান ক্লাব রেড স্টার বেলগ্রেডের  ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন প্রোসিনেস্কি।

মাদ্রিদের এমন খেলোয়াড়দের প্রতি আলাদা একটা টান থেকেই ১৯৯১ সালে ১৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাঁকে দলে ভেড়ায় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। তবে তিন বছরের ক্যারিয়ারে তেমন কিছুই নেই বলার মত। ব্যর্থদের তালিকায় তিনিও রয়ে গেলেন।

  • হামেস রদ্রিগেজ

২০১৪ সালের বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জেতা হামেস রদ্রিগেজের মধ্যে ছিল প্রবল সম্ভাবনা। একটা স্ফুলিঙ্গ তিনি দেখিয়েছিলেন ব্রাজিল বিশ্বকাপে। চটজলদি কোন রকম হেলাফেলা না করে তাঁকে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হামেসের ক্যারিয়ারটা আলোঝলমলে হতে পারেনি।

জিনেদিন জিদানের অধীনে ক্রমশ তিনি একাদশে জায়গা হারান। ধারে খেলে শেষমেশ ৮০ মিলিয়ন ইউরোতে কেনা খেলোয়াড় চলে যান অন্যত্র বিনে পয়সায়। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের এমন ছন্দপতনের দায়ভার কেবলই তাঁর নয়। মাদ্রিদের পরিকল্পনাও বেশ খানিকটা দায়ী।

  • ওয়াল্টার স্যামুয়েল

ইতালিয়ান ক্লাব রোমায় থাকতে ওয়াল্টার স্যামুয়েল খেতাব পেয়েছিলেন ‘দ্য ওয়াল’। রক্ষণের দেয়াল ছিলেন তিনি। তবে দুভার্গ্যজনকভাবে মাদ্রিদের দেয়াল আর হয়ে উঠতে পারেনি স্যামুয়েল। ২০০৪ সালে হন্যে হয়ে সেন্টার ব্যাক খোঁজা মাদ্রিদ তাঁকে দলে ভেড়ায় ২৫ মিলিয়ন ইউরোতে।

তবে, সে অর্থের প্রতিদান দিতে পারেননি তিনি। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে তিনি ইতালিতে ফিরে গেলে। সেখানে ইন্টার মিলানের হয়ে নিজের স্বরুপে ফেরেন ওয়াল্টার স্যামুয়েল। রিয়াল মাদ্রিদের তাঁর ছন্দপতন এক বিস্ময় হয়েই রইল।

  • জ্যাভিয়ের স্যাভিওলা

চিরপ্রতিদ্বন্দীদের ডেরা থেকে জ্যাভিয়ের স্যাভিওলাকে নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসে রিয়াল মাদ্রিদ। বার্সেলোনার হয়ে দারুণ ছন্দে থাকা স্যাভিওলা মাদ্রিদে এসে বনে যান একজন ‘বেঞ্চ ওয়ার্মার’।

বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামার সুযোগ আসতো কালেভদ্রে। তাঁর পিছনে কোন অর্থ দিতে হয়নি লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। চিরপ্রতিদ্বন্দীকে খানিকটা ফুসিয়ে দেওয়ার জন্যে হয়ত ব্যবহৃত হয়েছিলেন স্যাভিওলা।

  • জনাথন উডগেট

নিউক্যাসেল ইউনাইটেড থেকে ২০০৪ সালে জনাথন উডগেটকে কিনে নেয় মাদ্রিদ। খরচ করে ১৮.৩ মিলিয়ন ইউরো। তবে তিনি যেন কেবলই ছিলেন এক মূর্তি।

ইনজুরির মায়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসা হয়ে ওঠেনি উডগেটের। রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারের আদ্যোপান্ত তিনি জর্জরিত ছিলেন ইনজুরিতে। সে সময়ের প্রতিভাবান তারকা খেলোয়াড় সময়ের সাথে বনে যান নিভে যাওয়া এক প্রদীপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link