মেয়েদের জন্য আলাদা আইসিসি!

আপনি যদি আইসিসি চেয়ারম্যান গ্রেগ বার্কলের সাম্প্রতিক মন্তব্য শুনে থাকেন, তাহলে আপনি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় অবাক হতে বাধ্য। কারণ তিনি কার্যত নারীদের টেস্ট ক্রিকেটের মৃত্যু ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি বিবিসির টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল নামক পডকাস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সত্যিই আমি নারীদের টেস্ট বা দীর্ঘ ফরম্যাটের ক্রিকেটকে কোনভাবে বিকশিত হতে দেখতে পাচ্ছি না। এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা [সদস্যরা] টেস্ট ক্রিকেট খেলা বেছে নিতে পারবেন না, তবে আমি সত্যিই এটিকে বাস্তবে এগিয়ে যেতে দেখছি না।’

বার্কলের মতে নারীদের সাদা পোশাকের ক্রিকেট ‘টাকা নষ্ট করছে’।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষদের টেস্ট ক্রিকেটও লোকসানের করছে, কিন্তু বার্কলে তাতে কিছু মনে করেন না। কারণ, তার মতে, ‘পুরুষদের টেস্ট ক্রিকেট খেলাটির ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে – এই ব্যাপারটি খেলাটিকে অনন্য করে তোলে।’

অথচ নারীরা ১৯৩৪ সাল থেকে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে। যেখানে ভারতের (প্রথম টেস্ট, ১৯৩২) পুরুষদের প্রায় সমসাময়িক সময় থেকে তাঁরা টেস্ট অঙ্গনে পদার্পণ করেছে। এমনকি পাকিস্তান (প্রথম টেস্ট, ১৯৫২) এবং শ্রীলঙ্কার (প্রথম টেস্ট, ১৯৮২) পুরুষদের তুলনায়  প্রায় দীর্ঘ সময় ধরে যে নারীরা টেস্টের দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে বিষয়টি গ্রেগ বার্কলের মনোযোগ এড়িয়ে গিয়েছে।

বার্কলে কেবল ইতোমধ্যেই বিদ্যমান একটি আইসিসি নীতির পুনরাবৃত্তি করেছে। আইসিসি ২০০৫ সালে নারী ক্রিকেটের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধুমাত্র ২০ টি নারী টেস্ট খেলা আয়োজন করেছে। যাদের অধিকাংশই (১১) ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হয়েছে; দক্ষিণ আফ্রিকা দুটি, ভারত সাতটি এবং নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী দল একটিও টেস্ট খেলার সুযোগ পায়নি।

আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেটের প্রথম ৭১ বছরের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, যেখানে এই সমস্ত দেশের মধ্যে মাল্টি-টেস্ট সিরিজ ছিল আদর্শ। এবং আপনি বুঝতে পারবেন যে আইসিসি তার আন্ডারে নারীদের টেস্ট ক্রিকেটের অস্তিত্বকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য বেশ কার্যকর কাজ করেছে।

নারী ক্রিকেটের লেখিকা এবং ইতিহাসবিদ রাফ নিকোলসন ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে তাঁর লেখা কলামে বার্কলের নারী ক্রিকেট নিয়ে এমন দৃষ্টিভঙ্গির কড়া সমালোচনা করেছেন।

এখানে ভিন্ন কোন সমাধান থাকতে পারে কি ?

নারী ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ রাফ নিকোলসন বলেন, কখনো কখনো তিনি একটি বিকল্প মহাবিশ্বের স্বপ্ন দেখেন। যেখানে আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট কাউন্সিল (আইডব্লিউসিসি) ২০০৫ সালে নারী ক্রিকেটের দায়িত্ব আইসিসির কাছে হস্তান্তর করে, নিজেকেই বিলীন করে দেয়ার তরে ভোট নি। নিকোলসনের হতাশার জায়গা হলো, তখন যদি আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট কাউন্সিল একটু দুরদর্শী হতো!

অথচ ১৯৫৮ সাল থেকে এককভাবে নারীদের ক্রিকেট পরিচালনা করে আসছিল আইডব্লিউসিসি। যখন নারী ক্রিকেটারদের পুরুষদের সাথে আরও মিলেমিশে কাজ করার আলোচনা উত্থাপিত হয়েছিল, নিকোলসনের মতে তখন নারী ক্রিকেট কাউন্সিলের উচিত ছিল এর একটি সাব-গ্রুপ হিসেবে থেকে যাওয়া।

১৯৯৯ এর গভর্নেন্স প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘নারী ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য আইসিসি-র একটি সাব-গ্রুপ হিসেবে তাঁরা কাজ করতে পারে। নারী ক্রিকেটের জন্য পৃথক কর্মকর্তা ও প্রশাসক থাকবে, যারা সরাসরি আইসিসি-র সিইও কে রিপোর্ট করবে।’

যদি এটি ঘটে থাকতো তবে সম্ভবত এখনো নারীদের টেস্ট খেলা ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে অব্যাহত থাকত।

যদি সত্যিই এখনো আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি থাকতো তবে নারী ক্রিকেটের চাহিদাগুলো আরও জোরালোভাবে উত্থাপিত হতো। তাহলে হয়ত আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট কাউন্সিল এর সব কাজ নারীরাই পরিচালনা করতো, পুরুষদের নাক গলানোর সুযোগ থাকত না। যারা নারী ক্রিকেটকে খুব ভালোভাবে জানেন তাঁরাই এই কমিটির দায়িত্ব পালন করতেন। যেমন আইডব্লিউসিসির শেষ সভাপতি ছিলেন ক্রিস্টিন ব্রিয়ারলি। যিনি সাউথ ওয়েলস নারী সমিতির সভাপতি ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ান নারী  ক্রিকেট কাউন্সিলে আট বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং অস্ট্রেলিয়ান নারী ক্রিকেট দলকে পরিচালনা করেন।

বাস্তবে আসলে কি ঘটেছে? আইডব্লিউসিসি একটি উপ-গ্রুপ হিসাবে চালিয়ে যাবে এমন পরামর্শটি আইসিসি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল, বরং তাঁরা এটিকে সম্পূর্ণ দখলের জন্য জোর দিয়েছিল। আইসিসি-এর মধ্যে একটি আইডব্লিউসিসি সাব-গ্রুপ হলে সমস্যা ছিল যে এটির খুব বেশি স্বাধীনতা থাকবে।

২০০২ সালে প্রকাশিত নারীদের ক্রিকেটের উপর একটি যৌথ আইসিসি-আইডব্লিউসিসি রিপোর্ট আইডব্লিউসিসিকে একটি কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে শেষ করেছে, এই বলে যে একটি পৃথক সত্তা হিসাবে নারী ক্রিকেটকে স্বীকৃতি পেতে বেশ লড়াই করতে হবে। যারা আইডব্লিউসিসি পরিচালনা করছেন তারা তাই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে সংস্থাটি  দ্রবীভূত করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমরা জানি, ৩১  মে ২০০৫-এ কি হয়েছিল!

শেষ পর্যন্ত, সেই বছর যা হয়েছিল তা হলো আইডব্লিউসিসি এর সকল বাণিজ্যের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া। ফলে বাধ্য হয় আইডব্লিউসিসি-র পরিচালকরা আইসিসির হাতে এটিকে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে, নারী ক্রিকেট তার স্বায়ত্তশাসন বিসর্জন দিয়েছে, এবং তাদের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ আইসিসিকে হস্তান্তর করতে হয়েছে। যেমন বার্কলে-এর মন্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে তিনি নারীদের খেলার স্বতন্ত্র ইতিহাসটুকুও বোঝেন না। যা আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেট কাউন্সিল এর নারী সদস্য ঠিকি অনুধাবন করার কথা।

২০০৫ সালের হস্তান্তরের ঘটনাকে নতুন করে হয়তো ঘটানো যাবেনা, কিন্তু এখনো নারী ক্রিকেট কাউন্সিল এর নিজ হাতে কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে নেয়ার জন্য খুব বেশি দেরী হয়ে যায়নি। যারা আদতেই নারী ক্রিকেট নিয়ে ভাবে তাঁদের কাঁধে এই গুরুদায়িত্ব টা তুলে দেয়া উচিত।

রাফ নিকোলসন মতে নারীদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল আলাদা হলে তাঁরা স্বাধীনভাবে সিদ্বান্ত নিতে পারবে, আইসিসি তখন নারীদের কি করা উচিত আর কি খেলা অনুচিত তা ছকে বেঁধে দিতে পারবেনা। তখন আইডব্লিউসিসি মিডিয়াসত্ব থেকে অর্জিত মুনাফা নিজেরাই পরিচালনা করবে।

প্রাথমিকভাবে এই নতুন কাঠামো কিছু জটিলতা তৈরি করতে পারে – কারণ তখন সদস্য বোর্ডগুলিকে একটিমাত্র সংস্থার পরিবর্তে একটি নতুন নারী আইসিসি এবং পুরুষদের আইসিসির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। যদিও তাঁরা এই কাজটি ২০০৫  পূর্ববর্তী সময়ে করেছিল।

তাই নিকোলসন নিশ্চিত যে তাঁরা মানিয়ে নেবেন। আইসিসির ১৭ বছরের শাসনামলের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধু পুরুষরা দায়িত্ব নিলেই পরিপূর্ণ সফলতা আসেনা। কিন্তু নি:সন্দেহে নারী ক্রিকেটের দায়িত্বে আবার এমন লোক দরকার যারা নারীদের খেলাকে অগ্রাধিকার দিবে, যারা নারীদের ক্রিকেট খেলার দৃষ্টিভঙ্গি ও তার ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে জানবে ও সম্মান করবে। নারীরাও ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে মাঠ দাপিয়ে বেড়াক বাধাহীনভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link