তাঁর ক্যারিয়ার রেকর্ডে একসঙ্গে দুই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। প্রথমে জন্মস্থান আয়ারল্যান্ডের হয়ে এবং পরবর্তিতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। রিভার্স সুইপ শটে ছিলেন দারুণ দক্ষ। ঠিকই ধরেছেন, ইংল্যান্ড দলের সাবেক ওডিআই অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যানের ইঙ্গিতই দিয়েছি। ২০২২ সালের জুনে তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানান।
এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ইংলিশদের সাদা বলের ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে তিনি নেতৃত্ব কাঁধে নেয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে খেলার ধরণই পাল্টে যায়। তাঁরই হাত ধরে ২০১৯ সালে ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি ২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
মরগ্যান কিভাবে ইংল্যান্ড দলকে ওয়ানডে ক্রিকেটে পরিপক্ব করেছেন, সেই অবদানটুকু জানা যাক।
- অল আউট অ্যাটাক
মরগ্যান দায়িত্ব নেয়ার আগে ইংল্যান্ড দলের লক্ষ্য থাকত পুরো ৫০ ওভার পর্যন্ত টিকে থেকে ব্যাটিং করে যাওয়া। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সদ্য নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয়া মরগ্যান তখনো ঘষেমেজে ইংলিশদের বদলানোর সুযোগ পান নি। দেখা গেল সেইবার পুরো ৫০ ওভার টিকে থাকতে গিয়ে পার ওভারে ইংল্যান্ডের রান রেট ৫.৪৮ থাকতো। ইংলিশদের খেলার কৌশলে ভিন্নতা আনা দরকার এই উপলব্ধি থেকে তিনি নতুন করে পরিকল্পনা আঁটলেন।
মরগান বলেন, ‘আমি চাই ছেলেরা আক্রমণের মানসিকতা নিয়ে খেলুক, ৫০ ওভার টিকে থাকা নিয়ে না ভাবুক। দ্বিধায় না থেকে তাঁরা তাঁদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলুক।’ এই কৌশল অবলম্বনের পর ইংল্যান্ড ওয়ানডেতে বড় বড় স্কোর করতে শুরু করে। ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিং এর অ্যাটাকিং সাইদ বের করে আনার কারিগর হলেন মরগ্যান।
২০১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ছিল দ্রুততম স্কোর করা দেশ, এবং মরগ্যানের অল আউট কৌশল ইংলিশদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেয় সেবার।
- অভিজ্ঞতার সুযোগ
ওয়ানডে বিশ্বকাপে সফলতার চাবিকাঠি হলো একদিনের ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা। ২০১৫-১৯ এর সময়কালে ইংল্যান্ড ১৩ জন ক্রিকেটারকে কমবেশি অন্তত ৪০ টি ম্যাচে সুযোগ দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে মরগ্যান ফর্মের তোয়াক্কা করেননি। বরং দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশস্বরূপ ফর্মে না থাকলে খেলার সুযোগ দিয়েছেন।
যেমন, জেসন রয় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পুরো ওয়ানডে সিরিজে সবমিলিয়ে ৪০ রান করতে না পারলেও, তাঁকে পরবর্তী সিরিজে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি ফর্ম ফিরে পেতে থাকলেন।
- মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা
মরগ্যান আবিষ্কার করেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের আক্রমণাত্মক ধরণ সমতল পিচ এবং ছোট বাউন্ডারিগুলির জন্য উপযুক্ত। যা সাধারণত নিজেদের ঘরের মাটিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ধীর পিচ তাদের দুর্বল করে দেয়। ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘উইকেট ধীরগতির হবে, কম হবে- আইসিসি ইভেন্টের ধরণই এমন।’
হেডিংলেতে শ্রীলঙ্কার কাছে এবং লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে ওই পিচে ইংল্যান্ড কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। তখন গ্রুপ পর্বে অবশ্য জয় পেতে হবে- এমন ম্যাচগুলোতে তাঁরা তাঁদের খেলার কৌশলকে আরও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। ভয় পেয়ে নিজেদের আক্রমণাত্মক খেলার ধরণ না বদলে বরং মাঠটাকে মানিয়ে নিয়ে খেলার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। যা তাঁদের নিয়ে যায় বিশ্বকাপ শিরোপা অব্দি।
বিশ্বকাপের প্রাক্বালে দুটি বড় ডাক দিয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন যে ইংল্যান্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মানিয়ে নিতে পারে। দক্ষ টি–টোয়েন্টি বোলার জোফরা আর্চারকে যখন পাওয়া যায়, তখন ডেভিড উইলির আগে তাকে স্বল্প নোটিশে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি পুরো টুর্নামেন্টে তাদের প্রধান উইকেট শিকারী ছিলেন এবং ফাইনালের সুপার ওভারে ঠাণ্ডা মাথায় বোলিং করে ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
অন্য সিদ্বান্তটি ছিল ড্রাগ টেস্টে ব্যর্থ হওয়া অ্যালেক্স হেলসকে শর্ট নোটিশে দল থেকে সরিয়ে দেয়া। এর মাত্র ছয় মাস আগে, মরগান – তৎকালীন টেস্ট অধিনায়ক জো রুটের সাথে শ্রীলঙ্কা সফরে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের অনুসরণ করার জন্য ‘সাহস, ঐক্য এবং সম্মান’ নামক মন্ত্রের রূপরেখা দিয়েছিলেন। হেলস এর স্থলাভিষিক্ত জেমস ভিন্সকে নিয়ে অন্তত ঝুঁকি নিতে হয়নি দলের।
- গভীরতা তৈরি করা
মরগ্যানের আন্তর্জাতিকে আক্রমণাত্মক ধরণের প্রভাব ঘরোয়া ক্রিকেটেও ছড়িয়ে পড়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলোয়াড়রা তখন দারুণ ইনিংস খেলতে থাকে, যা বিশ্বজুড়ে তাঁদের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার সুযোগ করে দেয়। এবং দক্ষতা বিকাশের সুযোগ দেয়।
মরগ্যান বিশ্বাস করতেন ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের আরও বেশি বেশি ফাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলা উচিত। ২০২১ নাগাদ ইংল্যান্ড দলের প্রায় প্রত্যেক সদস্য তাদের ক্যারিয়ারে আইপিএলে অন্তত একবার খেলেছে। এবং বেশিরভাগই মত দিয়েছে যে, টুর্নামেন্টটি তাদের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
- বৈচিত্রকে মেনে নেয়া
মরগ্যান ছিলেন উদারমনা ও অসাম্প্রদায়িক। তিনি ভিন্নতাকে মেনে নিতেন। আদিল রশিদ কিংবা মঈন আলীর মত ব্রিটিশ সংস্কৃতির বাইরে থাকাদের সুযোগ দিতে তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেননি। এমনকি প্রয়োজনে ছাড়ও তিনি।
এমন পরিবেশটা যে মরগ্যানই তৈরি করে দিতেন, সেটা একান্ত সাক্ষাৎকারেই বলে গেছেন আদিল রশিদ। আর এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই ইংল্যান্ড দলকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছিল, করেছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। আর মরগ্যানও একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক হিসেবেই টিকে রইবেন ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়।