নেদারল্যান্ডসের আয়াক্স আমস্টারডাম ক্লাবের সাথে স্পেনের বার্সেলোনার এক অদৃশ্য সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কের রূপকার ডাচ সন্তান ইয়োহান ক্রুইফ। আয়াক্সের হয়ে মাঠ মাতানো’র পর তিনি ন্যু ক্যাম্পেও বিল্পব সৃষ্টি করেছিলেন। সেই থেকে খেলার ধরণ আর ফুটবলীয় দর্শনে বেশ মিল পাওয়া যায় দুই দেশের দুই পরাশক্তির মাঝে।
ইয়োহান ক্রুইফের পদচিহ্ন অনুসরণ করে আরেক ডাচ ফুটবলারও আয়াক্সে বেড়ে উঠে পরবর্তীতে কাতালানদের আপন একজন হয়েছিলেন। তিনি প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট – কিংবদন্তি একজন স্ট্রাইকার, একসময় যাকে রোনালদো লিমা’র পরেই সেরা নাম্বার নাইন ভাবা হতো।
প্যাট্রিক ক্লুইভার্টের জন্ম ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ের প্রথমদিনে। নেদারল্যান্ডসের সর্বত্রই সেসময় ইয়োহান ক্রুইফের কল্যানে ফুটবলের জোয়ার উঠেছিল। আর সেটির ছোঁয়া ছোট্ট ক্লুইভার্টকেও ছুঁয়ে গিয়েছে। ছোট বুকের মাঝে শুরু করেছিলেন বড় স্বপ্ন বোনার কাজ – একদিন ফুটবলার হবেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়সে ASV Schellingwoude এর একাডেমিতে যোগ দিয়ে নিজের স্বপ্নের পথে প্রথম পা বাড়ান ক্লুইভার্ট।
তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রেক থ্রু আসে ১৯৮৪ সালে। সেসময় নেদারল্যান্ডসের সেরা ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডামের যুব একাডেমিতে ট্রায়াল দেয়া হচ্ছিলো ক্ষুদে প্রতিভাবানদের। ক্লুইভার্টের বাবা তাকে সেখানে নিয়ে যান। কিন্তু শত শত ছেলেদের উপস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে যান ক্লুইভার্ট। এমনকি সবকিছু ফেলে পালাতেও চেয়েছিলেন তিনি। তবে বাবার অনুপ্রেরণায় শেষপর্যন্ত প্যাট্রিক অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আয়াক্সের একাডেমিতে ভর্তির সুযোগ পান।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ডিফেন্স সহ বিভিন্ন পজিশনে খেলতেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। দুর্দান্ত কৌশল, ফুটবল বুদ্ধিমত্তা, গতি আর দৈহিক শক্তিতে মুগ্ধ করেছিলেন সেখানকার কোচদের। এছাড়া একাডেমিতে থাকাকালীন ক্লুইভার্ট ডাচ জাতীয় দলের হয়ে অনূর্ধ্ব ১২, অনূর্ধ্ব ১৫, অনূর্ধ্ব ১৭ এর মত দলগুলোতেও খেলেছিলেন।
১৯৯৪ সালের ২১ আগস্ট ১৮ বছর বয়সে আয়াক্সের মূল দলের হয়ে অভিষেক হয় তরুণ স্ট্রাইকারের। তার অভিষেক ম্যাচেই প্রতিদ্বন্দ্বী ফেয়েনূর্দের বিরুদ্ধে জয়ের দেখা পায় আয়াক্স, এছাড়া দলের প্রথম গোলটিও এসেছিল ক্লুইভার্টের পা থেকে। দারুন প্রতিভাবান এই ফুটবলার নিজের প্রথম মৌসুমে ডাচ লিগের ২৫টি ম্যাচে ১৮টি গোল করে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন। তার এমন পারফরম্যান্সের কারণেই কোন ম্যাচ না হেরে ডাচ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয় আয়াক্স।
একই মৌসুমে ক্লুইভার্ট ইউরোপীয় মঞ্চেও তার ঈর্ষনীয় পারফরম্যান্স দেখান। সে বছর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতে নিয়েছিল ডাচ ক্লাবটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে এসি মিলানের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেছিলেন ক্লুইভার্ট। এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করা সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফুটবলার এই স্ট্রাইকার।
পরের মৌসুমেও নিজের দাপট ধরে রাখেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। সেবার ২৮টি ম্যাচে ১৫ গোল করে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে যান। অবশ্য ইনজুরির কারণে ১৯৯৬/৯৭ মৌসুমে মাত্র ১৭ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন ক্লুইভার্ট। আর এরপরের ট্রান্সফার উইন্ডো-তেই এসি মিলানে চলে আসেন তিনি। সবমিলিয়ে আমস্টারডাম ক্লাবের হয়ে ১০০ টি ম্যাচ খেলে ৫২টি গোল করেছিলেন ক্লুইভার্ট, এছাড়া এর পাশাপাশি ১৬টি অ্যাসিস্টও করেছিলেন তিনি।
ইতালিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে প্যাট্রিক ক্লুইভার্টের। প্রথম মৌসুমে মাত্র ৯ গোল করতে সক্ষম হন তিনি, হয়তো সেই কারনে আবার বদল আনেন নিজের ঠিকানায়। এবার স্পেনের বার্সেলোনাতে। এখানেই নিজের সবচেয়ে সেরা সময়টা কাটিয়েছেন ক্লুইভার্ট।
১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ব্লাউগানা জার্সি গায়ে জড়িয়ে তিনি খেলেছেন জিতেছেন। প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফুটবলার রিভালদোর সঙ্গে জুটি গড়ে ত্রাস জড়িয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স লাইনে। স্পেনে নিজের প্রথম বছরে আবারো দলের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার হন ক্লুইভার্ট।
সব মিলিয়ে বার্সাতে কাটানো ছয় বছরের সময়ে তিনবারই এই কীর্তি গড়েছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে কাতালান ক্লাবটির হয়ে ২৫৭ ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। গোলের দেখা পেয়েছিলেন ১২২ বার এবং সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো ৬০টি গোল।
বার্সেলোনা ছেড়ে এরপর নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন ক্লুইভার্ট। সেখানে এক বছর কাটানোর পরে অবশ্য আবারো দল বদলাতে হয় তাকে। পুনরায় আসেন স্পেনে, তবে এবার ভ্যালেন্সিয়ার জার্সিতে। কিন্তু এবার ইনজুরিতে লম্বা সময়ের জন্য বাইরে থাকতে হয়েছে তাকে। পুরো মৌসুমে মাত্র ২০২ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন এই তারকা।
শেষমেশ নিজের দেশে ফিরে আসেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। পিএসভি’র হয়ে একবছরের চুক্তি করেন তিনি। অবশ্য ইনজুরি তাকে ছেড়ে যায়নি, ধীরে ধীরে ফর্মের হারিয়ে ফেলতে থাকেন এই স্ট্রাইকার। শেষপর্যন্ত ২০০৮ সালে ফ্রান্সের ক্লাব লিঁলের হয়ে একবছর খেলে পেশাদার ফুটবলে ইস্তফা দেন তিনি। অবসরের পর থেকে কোচিং ক্যারিয়ারেই আছেন এই ডাচ সুপারস্টার।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজের ছাপ রাখতে ভুল হয়নি প্যাট্রিক ক্লুইভার্টের। ২০১৩ সালে রবিন ভ্যান পার্সি ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে জাতীয় দলের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে আসীন ছিলেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। নেদারল্যান্ডসের কমলা জার্সিতে ৭৯ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৪০ গোল আর ৭ অ্যাসিস্ট।
নিজের বর্নাঢ্য এক ক্যারিয়ারে তিনবার ডাচ লিগ এবং একবার স্প্যানিশ লিগ জিতেছিলেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট। আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বাদও পেয়েছিলেন। এছাড়া ইন্টারকন্টিনেন্টাল ট্রফি, ডাচ সুপার কাপ এবং উয়েফা সুপার কাপও রয়েছে তার অর্জনের খাতায়। ইউরো-২০২০ এ জাতীয় দলের হয়ে গোল্ডেন বুট পেয়েছিলেন এই কিংবদন্তি।
চমৎকার ফার্স্ট টাচ এবং দ্রুতগতির অধিকারী ছিলেন ক্লুইভার্ট। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার রোনালদোর মতোই তিনি তার গতি, ফুটবলীয় দক্ষতা, নিয়ন্ত্রণ এবং বুদ্ধিমত্তার কারণে নজর কেড়েছিলেন। ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ক্রুইফ টার্ন’-কে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করতেও দেখা যেত তাঁকে। নিজের উচ্চতা, শক্তি এবং দৃঢ় শরীর ব্যবহার করে বল দখলের লড়াইয়ে আধিপত্য ধরে করতে পারতেন তিনি।
নিজের প্রজন্ম ছাড়িয়ে ইতিহাসের সেরাদের সেরা হওয়ার সুযোগ ছিল ক্লুইভার্টের সামনে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পারেননি, বলা যায় ইনজুরির ছোবল তাকে সেই আরাধ্য মাইলফলকের কাছে যেতে দেয়নি। আয়াক্স কিংবা বার্সেলোনার হয়ে যেভাবে ক্যারিয়ারের শুরুটা তিনি করেছিলেন, সেই গতি আর সাফল্য পরবর্তী ছয় সাত বছরে আর খুজে পাননি৷
ইনজুরি আর অফ ফর্মের কারনে বারবার বদলাতে হয়েছে ক্লাব। সর্বকালের সেরাদের একজন না হওয়ার এই আক্ষেপ আর অতৃপ্তি হয়তো এখনো কিছুটা আছে প্যাট্রিক ক্লুইভার্টের হৃদয়ে৷