এনামুল হক বিজয়, ডানহাতি এই ওপেনার অভিষেকের পরে বেশ আলো ছড়িয়েছিলেন। টেকনিকে সমস্যা থাকলেও বড় ইনিংস খেলতে পারতেন, রান করতে পারতেন। বাংলাদেশও ভরসা রেখেছিলো তাঁর ওপর। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এক কাঁধের ইনজুরি বদলে দেয় এনামুলের ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
এরপর থেকে লম্বা সময়ের জন্য দলের বাইরে ছিলেন তিনি। মাঝে ২০১৮ সালে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ালেও পুরোনো এনামুলকে পাওয়া যায়নি। তাই আবারো ফিরে যেতে হয়েছে ঘরোয়া লিগে। অবশ্য এরপর আর খুব একটা আলোচনায় ছিলেন না এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ, এমনকি জাতীয় ক্রিকেট লিগেও বিজয়ের ব্যাট ছিল শান্ত।
তবে হঠাৎ যেন জেগে উঠে তার ব্যাট, ২০২২ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দেখা যায় নতুন এনামুল হক বিজয়কে। টূর্নামেন্টে ১৫ ম্যাচে খেলে করেছিলেন ১১৩৮ রানের। দেশের ইতিহাসে কোন লিস্ট-এ ক্রিকেটের টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান তো বটেই, বিশ্বের কোন প্রান্তেই লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের একটি আসরে এত রান করতে পারেনি কেউ-ই।
নয়টি অর্ধশতকের পাশাপাশি এনামুল হাঁকিয়েছেন তিনটি শতক। পুরো টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমানভাবে দাপট দেখিয়েছেন প্রাইম ব্যাংকের এই ওপেনার। মজার ব্যাপার, ডিপিএলে বল হাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে, এমনকি দুইটি উইকেটও পেয়েছেন।
এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পর তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে জাতীয় দলে ফেরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। ডিপিএলে বিধ্বংসী এনামুলকে দেখার পর সবাই ধরেই নিয়েছিল নিজপর ভুলত্রুটি শুধরে তিনি হয়তো নতুন কিছু নিয়েই ফিরছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথমে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে ডাক পেয়েছিলেন, পরে অবশ্য অন্যদের ইনজুরিতে টেস্টেও নেয়া হয় তাকে।
সাদা পোশাকে অকস্মাৎ পাওয়া সুযোগটা যদিও কাজে লাগাতে পারেননি এনামুল। দ্বিতীয় টেস্টের দুই ইনিংসে ফিরে গিয়েছেন যথাক্রমে ২৩ এবং ৪ রান করে। এছাড়া মাঠে দেখা গিয়েছিল তার পুরোনো সেই ফুটওয়ার্কের ভুল। তবে এমন পারফরম্যান্সের পরেও বিজয়ের উপর ভরসা হারায়নি কেউই। ঘরোয়া চার দিনের ম্যাচে ফর্মে না থাকা এনামুলের কাছে টেস্ট পারফরম্যান্স তো কেউ আশাও করেনি।
আশা করেছিল রঙিন পোশাকে, কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন বিজয় নিজেই। ঘরোয়া আসরে ফোয়ারার মত রান করা এনামুল ক্যারিবিয়ান বোলারদের সামনে রান করাই ভুলে গিয়েছেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম ম্যাচে করেছেন ১০ বলে ১৬। স্ট্যাম্পের বল আগেই অফ সাইডে সরে এসে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়েছিলেন। এই ম্যাচে তো তবু একটু টি-টোয়েন্টি অ্যাপ্রোচে ব্যাটিং করতে চেয়েছিলেন বিজয়, পরের দুই ম্যাচে সেই ভয়ডরহীন মানসিকতাও ছিল না তার মাঝে।
সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে চার বলে তিন করেছিলেন। আউট হওয়ার ধরন দেখলে মনে হবে বিজয় যেন পায়ের কাজ ভুলে গিয়েছেন। জায়গা দাঁড়িয়ে পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ স্ট্যাম্পের বল খেলতে গিয়ে ইনসাইড এজ হয়ে বোল্ড হয়ে ফিরে যান তিনি। আর সিরিজের শেষ টেস্টে এগারো বলে দশ রান করে আউট হয়ে ব্যর্থতাকে পরিপূর্ণ রূপ দিলেন।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গুণগত মানের যে পার্থক্য সেটি আরো একবার এনামুল বিজয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। পরিচিত, অর্ধপরিচিত দেশীয় বোলারদের বল অনায়াসে খেলা বিজয় এখন পারছেন না ওবেড ম্যাকয়, রোমারিও শেফার্ডদের মত গড়পড়তা আন্তজার্তিক বোলারদের মোকাবিলা করতে। রান সংখ্যা দূরে রাখলেও, বিজয়ের ব্যাটিং সামর্থ্য মন ভরাতে পারেনি সাধারণ দর্শক কিংবা ক্রিকেট বিশ্লেষকদের।
অবশ্য ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে সরাসরি জাতীয় দলে আনার প্রক্রিয়া সঠিক কিনা সেটিই নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। ডিপিএলে বিজয়ের এমন পারফরম্যান্সের পর তাকে এ’ দলে নেয়া যেত, এরপর দুই একটি অ্যাওয়ে সিরিজ খেলার পর বোঝা যেত তার প্রকৃত অবস্থান। তবে বাংলাদেশ বলে কথা, এখানে তো এ’ দলের অস্তিত্ব কাগজে কলমেই আছে শুধু। নিয়মিত সিরিজও খেলা হয় না তাদের।
এখনো অবশ্য সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি এনামুল হক বিজয়ের। সামনে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের ম্যাচগুলোতেও হয়তো একাদশে থাকবেন তিনি। এরপর জিম্বাবুয়ে সফরেও তার সুযোগ পাওয়া একপ্রকার নিশ্চিত। আন্তজার্তিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে এই সুযোগ গুলো কাজে লাগানোর জন্য বিজয়কে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। বিজয় পারফর্ম করতে পারলে তো ভাল। না হলে আবারো জাতীয় দল থেকে ফিরে যেতে হবে মাথা নিচু করে। যেমনটা এখন পর্যন্ত উইন্ডিজ সফরে বিজয়ের নিয়মিত দৃশ্য।