বাদল রায়, এক কিংবদন্তির প্রয়াণ

১৯৭৬ সালের ঘটনা।

মোহামেডানের মাঝমাঠ কাঁপাচ্ছেন তখন কুমিল্লার প্রণব কুমার দে; লোকেদের আদরের ভানুদা। এই ভানুদা তখন ঢাকা মোহামেডানের জন্য জনা দুয়েক তরুণ খেলোয়াড় খোজ করছিলেন। বিশেষ করে স্ট্রাইকার দরকার ছিলো একজন। ঢাকায় সেরকম স্ট্রাইকার চোখে পড়ছিলো না।

তখন লিগের শেষ সময়। এই সময়টায় ভানুদারা মোহামেডানের জনা চারেক খেলোয়াড় নিয়ে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে। সেখানেই প্রতিপক্ষ দলে ভানুদা দেখলেন লিকলিকে তরুণ এক স্ট্রাইকারকে। সাথে সাথে মনে ধরে গেলো ছেলেটিকে।

ভানুদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে, মোহামেডানে খেলবি?’

ছেলেটি লাজুক উত্তর দিয়েছিলো, ‘সুযোগ পেলে তো খেলবো, দাদা।’

ব্যাস। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভানুদার হাত ধরে ঢাকায় চলে এলো ছেলেটি। ভানুদা বললেন, বাংলাদেশের সেরা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পেয়ে গেছি। আসলেই তাই হলো, কালক্রমে তিনি ঢাকার ফুটবলে এবং জাতীয় ফুটবলের এর নীরব তারকায় পরিণত হলেন। হয়ে উঠলেন সেরা বল জোগানদাতা।

হ্যা, আমাদের বাদল রায়। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে শান্ত, সৌম্য এবং ঠান্ডা মাথার নেপথ্য তারকা বাদল রায়। সেই গ্রেট ফুটবলারই আজ চিরবিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।

বাদল রায় বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। ২০১৭ সালে ব্রেন হেমোরেজ হয়েছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছিলো। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন। এরপর এ বছর প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু জটিলতা বাড়তেই থাকে। ফলে নিয়ে আসা হয় শীর্ষ স্থানীয় আরেকটি হাসপাতালে। সেখানে তার চতুর্থ স্তরের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

কোনো আশা না থাকায় চিকিৎসকরা বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। তবে পরিবারের সদস্যরা তাকে প্রথমে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে বাংলাদেশ মেডিকেলে ভর্তি রাখেন। সেখানেই শেষ পর্যন্ত শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই ফুটবলার।

জীবদ্দশায় বাদল রায় ছিলেন ঢাকা মোহামেডানের প্রতীক।

১৯৭৭ সালে ভানুদাদের হাত ধরে অভিষেক হয় লিগে। প্রথম বছরে খুব বেশি ম্যাচ পাননি। পরের বছর থেকে নিয়মিত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন এই দলের। প্রথম দিকে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলেছেন। কিন্তু কালক্রমে একটু পিছিয়ে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে জায়গা করে নেন। হয়ে ওঠেন অসংখ্য গোলের প্রধাণ উৎস। সময়ে সময়ে গোল করানোর পাশাপাশি গোল করেছেনও। তবে গোল করানোটাই বেশি পছন্দ করতেন।

আবাহনীর বিপক্ষে প্রায় ফাকা পোস্ট পেয়েও বল সতীর্থকে দিয়ে দেন এবং গোল হয়। ম্যাচ শেষে বাদল রায়কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘আপনি গোলে শট করলেন না কেনো?’

বাদল হেসে বলেছিলেন, ‘ও বেটার পজিশনে ছিলো।’

এটাই বাদল রায়। কখনো গোলের মোহ বা খ্যাতির মোহ টানেনি তাঁকে। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত অধিনায়কত্ব করেছেন মোহামেডানে। অধিনায়ক হিসেবে লিগ জিতেছেন। আর খেলোয়াড় হিসেবে ছয়টি লিগ শিরোপা জিতেছেন। তার সেরা কীর্তি ছিলো আবাহনীকে হারিয়ে দেওয়া।

১২ বছরের ক্যারিয়ারে আবাহনীর বিপক্ষে পাঁচটি ভিন্ন ম্যাচে পাঁচটি গোল করেছেন। এই পাচ ম্যাচের একটি ছাড়া সব ম্যাচে মোহামেডান জয় পেয়েছে। বাদল রায় গোল পেলেই মোহামেডানের জয় অবধারিত ছিলো যেন।

জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্যি। জাতীয় দলেও গোল বেশী করিয়েছেন। কিন্তু যখন গোল করেছেন, বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। ১৯৮২ সালের এশিয়াডে বাংলাদেশ প্রথম এশিয়াড ম্যাচ জয় পায় মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। জয়সূচক গোলটা এই বাদল রায় করেছিলেন।

১৯৮৬ সালে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সাদা দলের। প্রেসিডেন্টস গোল্ড কাপ নামে এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে এই ‘প্রায় মোহামেডান’ দলটি সেমিফাইনাল খেলে।

এটা ঠিক যে, আবাহনী-মোহামেডান রেশারিশিতে সেরা ফর্মে থেকেও অনেক সময় একাদশে সুযোগ হয়নি। ঠিকমতো মূল্যায়ন তার হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। তারপরও মোহামেডান ছাড়েননি। বলা হয়, টাকার বস্তা দিয়েও বাদল রায়কে মোহামেডান থেকে কেনা যেতো না।

বাদল বরং মোহামেডানের রক্ষাকর্তা ছিলেন। কোনো তরুণ খেলোয়াড় মোহামেডান ছেড়ে যেতে চাইলে তাকে আটকানোর দায়িত্ব ছিলো এই বাদল রায়ের।

বাদল রায়ের খেলোয়াড়ী বৈশিষ্ট বলতে গিয়ে তার স্কিল, ড্রিবলিংয়ের প্রসঙ্গ আসবে। তবে সমকালীন খেলোয়াড়দের কাছে তিনি ছিলেন মিস্টার কুল। মাঠে মাথা ঠাণ্ডা রাখা, উত্তেজনাময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় তার জুড়ি ছিলো না।

১৯৮৯ সালে ফুটবল খেলাকে বিদায় বলেন। তারপরও ফুটবলের সাথেই ছিলেন। মোহামেডানের ম্যানেজার থেকে শুরু করে এই ক্লাবটির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া লম্বা সময় ধরে ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।

সর্বশেষ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধী হয়েছিলেন। পরে শারীরিক কারণে নাম প্রত্যাহার করে নিলেও ব্যালট পেপারে তার নাম ছিলো। সে নির্বাচনে জয় পাওয়া হয়নি।

অবশেষে এই ফুটবল, এই নির্বাচন, এই গোলের দুনিয়ার সাথে সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে ফেললেন বাদল রায়। তবে ফুটবল ইতিহাস থেকে নামটা তো মোছা যাবে না।

বিদায়, ফুটবল কিংবদন্তি!

__________________

এই লেখাটি তৈরী করা হয়েছে বাংলাদেশ ও ইউরোপের ফুটবলের নিয়মিত দর্শক শোয়েব হোসেন শামীমের সাথে কথোপকথনের প্রেক্ষিতে। বাদল রায় সম্পর্কে তথ্য ও মূল্যায়নগুলো তার কাছ থেকেই নেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link