ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক কারা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ছোটখাটো একটা তালিকা অনায়াসে তৈরি করে ফেলতে পারবে যে কোন ফুটবল ভক্ত। তবে সে তালিকায় হোসে লুইস ফেলিক্স চিলাভার্ট গঞ্জালেজের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না সেটা নিশ্চিত। খেলা গোল আটকানোই নয়, গোল করার ক্ষেত্রেও তাঁর জুড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন। অন্তত গোলরক্ষক হিসেবে। আচ্ছা, গোলরক্ষক কিভাবে আবার গোলমেশিন হন। চলুন, এবার সেই গল্পখানাই শুনি না হয়।
এই গোলরক্ষককে চেনেন এমন মানুষও খুব কম আছেন। অথচ সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের চেয়ে কোন অংশে কম নন এই প্যারাগুইয়ান তারকা।
১৯৬৫ সালের ২৭ জুলাই প্যারাগুয়ের লুকিউ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হোসে লুইস চিলাভার্ট। খুবই দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনকি সাত বছর বয়স পর্যন্ত খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছিল তাকে। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে গরুর দুধ বিক্রির কাজে লেগে পড়তে হয় চিলাভার্টকে।
কিন্তু চরম দারিদ্র থেমে গিয়েছিল ফুটবলের প্রতি লুইস চিলভার্টের ভালবাসার কাছে। তাঁর বড় ভাই রোলান্ড চিলাভার্টও ছিলেন একজন ফুটবলার। তাঁর কাছ থেকে প্রথম ফুটবলের তালিম নেন লুইস। তবে বড় ভাই মিডফিল্ডার হলেও লুইস চিলাভার্ট বেড়ে উঠেছিলেন গোলরক্ষক হিসেবে।
স্থানীয় ক্লাব স্পোর্টিভ লুকিয়নো এর হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় হোসে লুইস চিলাভার্টের। কিন্তু মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই নিজের শৈশব ক্লাব ছেড়ে চলে আসেন তিনি। এরপর এই গোলকিপার চলে আসেন ইউরোপে, রিয়াল জারাগোজার হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। দলটির হয়ে ৫৯ ম্যাচে ২২টি ক্লিনশিট রেখেছিলেন তিনি।
রিয়াল জারাগোজাতে খেলা শেষে লাতিন আমেরিকায় ফিরে আসেন লুইস চিলাভার্ট। আর্জেন্টাইন ক্লাব ভেলেজ সার্সফিল্ডে যোগ দেন তিনি। চিলাভার্ট থাকাকালে দলটির চারবার লিগ শিরোপা জয়ে সামনে থেকে অবদান রেখেছিলেন তিনি।
এছাড়া ১৯৯৪ সালে কোপা লিবার্তোদোরস এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছিলেন ভেলেজ সার্সফিল্ডের হয়ে।
১৯৯৯ সালে ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মত স্বীকৃত গোলরক্ষক হয়ে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি গড়েন লুইস চার্লভার্ট। অবশ্য সবকয়টি গোলই তিনি করেছিলেন পেনাল্টি থেকে। আবার রিভার প্লেটের বিপক্ষে মধ্যমাঠ থেকে দুর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে গোল করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন এই কিংবদন্তি।
সব মিলিয়ে ভেলেজের হয়ে ৪৪ টি ম্যাচে ২০ টি ক্লিনশিট রাখার পাশাপাশি তিনটি গোল করেছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে লিগের বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন চিলাভার্ট।
এরপর আবারো ইউরোপে ফিরে আসেন লুইস চিলাভার্ট। এবার গন্তব্য ফ্রান্সের স্ট্র্যাসবার্গ। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ তাদের হয়েই খেলেছেন চিলাভার্ট। ২০০১ সালে কোপা ডি ফ্রান্সের ফাইনালে ম্যাচ গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। আর সেদিন স্ট্র্যাসবার্গের জয়ের নায়ক ছিলেন চিলাভার্ট। শট ঠেকিয়ে নয়, বরং নায়ক বনে গিয়েছিলেন পেনাল্টি শুটআউটে জয়সূচক গোল করে।
শুধু যে বেশি ম্যাচ খেলছেন স্ট্র্যাসবার্গে, তা নয়। এই দলের হয়েউ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা ফর্ম উপভোগ করেছেন তিনি। ৬৬ ম্যাচে ৩০টি ক্লিনশিট, এর সাথে মাত্র ৬১ গোল হজম করার পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে।
বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারে আরো অনেক ক্লাবেই গোলপোস্ট সামলাতে দেখা গিয়েছে প্যারাগুয়ের এই কিংবদন্তিকে। তবে তিনি সবচেয়ে পরিচিত পেয়েছেন জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময়। বড় মঞ্চে তাঁর উজ্জ্বল পারফরম্যান্স বৈশ্বিক খ্যাতি এনে দিয়েছে চিলাভার্টকে।
প্যারাগুয়ে কখনোই ফুটবলের পরাশক্তি ছিল না, কিন্তু চিলাভার্টের সময় প্যারাগুয়ের খেলা দেখতো অনেকে। কেননা তাঁর দুর্দান্ত নৈপুণ্যে সেসময় বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে জানতো লাতিন আমেরিকার দেশটি।
১৯৮৮ সালের বিশ্বকাপ চিলাভার্টকে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্র এনে দিয়েছিল। তাঁর আন-অর্থোডক্স গোলকিপিং মুগ্ধ করেছিলো ফুটবলভক্তদের। ম্যাচে গোলকিপারদের পেনাল্টি নেয়াই যেখানে বিরল দৃশ্য, সেখানে প্রায় ফ্রি-কিকে শট নেয়ার জন্য উঠে আসতেন চিলাভার্ট। তাঁর জন্য এটি যেমন ছিল সাহসী আর ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি দর্শকদের জন্য ছিল উপভোগ্য। হয়তো তিনি নিজেও উপভোগ করতেন।
বল পায়ে আসলে প্রায় ড্রিবলিং করে উপরে উঠে আসতেন চিলাভার্ট। গ্যালারি থেকে ভীত দর্শকদের আওয়াজ পাওয়া যেত, তাদের কেউ কেউ আবার চিৎকার করে গোলপোস্টে ফিরে যাওয়ার জন্য বলতো তাকে। কিন্তু নিজের কাজে মনোযোগী এই গোলরক্ষক কখনো বাইরের কথায় কান দেননি।
গোলকিপার হয়েও তাঁর নামের পাশে আছে ৬২ টি গোল। সেট পিস, পেনাল্টি আর গোল করা – এসব তো বাড়তি পাওনা। একজন গোলরক্ষক হিসেবেও হোসে লুইস চিলাভার্ট ছিলেন সেরাদের একজন। শুধুমাত্র তাঁর কারনেই প্যারাগুয়ে সেসময় তাদের যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু অর্জন করেছিল।
হোসে লুইস চিলাভার্ট, বর্তমানে একজন ব্যতিক্রমী গোলরক্ষকের উদাহরণ হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা পেয়েছেন। অথচ ব্রাজিল, জার্মানির মত ফুটবলের কোন পরাশক্তির দেশের হয়ে খেললে সেরা হিসেবেই লেখা হতো তাঁর নাম।
পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে সেরা কয়েকজনের মতই ছিলেন তিনি। নিজের জাতীয় দল প্যারাগুয়ের নড়বড়ে অবস্থান তাকে পিছিয়ে দিয়েছে অন্যদের চেয়ে। লাইমলাইটেও আসতে পারেননি খুব একটা। ক্যারিয়ার শেষে তাই কিছুটা অপূর্ণতা হয়তো থেকে গিয়েছে এই কিংবদন্তি গোলরক্ষকের মনে।