২০০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার মাঠে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে জিতে ব্যাট করতে ভারত সেদিন কিছুটা ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। ৬৯ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল তারা। এরপর ১৭ বছরের এক তরুণ এসেছিলেন ব্যাট হাতে। শটের ফুলঝুরি ছুটিয়ে তিনি ৬৬ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস খেলেন।
আর সাথে দলকে এনে দেন নিরাপদ সংগ্রহ। উত্তর প্রদেশের এই ব্যাটার চাপের মুখে সাবলীলভাবে খেলেছিলেন। চাপের মুহুর্তে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ার এই স্বভাব পরবর্তীতে জাতীয় দলেও ধরে রেখেছিলেন তিনি। ভারত তো বটেই, নিজের সময়ে তিনি ছিলেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার।
বলা হয়েছে, সুরেশ কুমার রায়নার কথা। এক যুগেরও বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ভারতকে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। ম্যাচ পরিস্থিতি বিবেচনায় রায়নার কয়েকটি ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসের কথা স্মরণ করা যাক।
- ৮১* বনাম ইংল্যান্ড, ২০০৬
স্লো আর টার্নিং উইকেটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত তখন ২২৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমেছিল। শুরুটা ভাল হলেও হঠাৎ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ভারত, ৯২ রান তুলতেই ড্রেসিংরুমে চলে যায় পাঁচজন ব্যাটার। এরপর অনভিজ্ঞ সুরেশ রায়না গড়েন প্রতিরোধ।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে সাথে নিয়ে স্ট্রাইক রোটেশনের পাশাপাশি নিয়মিত বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দলকে নিয়ে যান জয়ের দিকে। শেষদিকে ধোনি আউট হলেও অপরাজিত থেকেই দলকে চার উইকেটের জয় উপহার দেন রায়না।
- ১০১ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১০
তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং লাইন আপে ছিল ডেল স্টেইন, মর্নি মরকেল, জ্যাক ক্যালিসের মত বড় বড় নাম। কিন্তু ২০১০ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এরা কেউই সুরেশ রায়নাকে থামাতে পারেনি। তারকাবহুল প্রোটিয়াদের বিপক্ষে নিজের ক্লাস আর টেকনিকের আরও একটি প্রদর্শনী করেছিলেন রায়না।
প্রথম ওভারে ব্যাট করতে আসা রায়না শেষ ওভারে আউট হয়েছিলেন। মাঝখানে চার ছয়ের মারে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তুলে নিয়েছিলেন প্রথম সেঞ্চুরি। তার দ্বিতীয় ফিফটি এসেছিল মাত্র ১৭ বলে; তাঁর এই বিধ্বংসী ইনিংসটি ম্যাচ শেষে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল।
- ৬২ ও ৪১* বনাম শ্রীলঙ্কা, ২০১০
বড় পার্টনারশিপ তৈরিতে ভিভিএস লক্ষ্মণের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। ভিভিএসের সাথেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত এক জুটি গড়েছিলেন সুরেশ রায়না। সেই সিরিজটি ছিল তাঁর অভিষেক সিরিজ। প্রথম ইনিংসের এক পর্যায়ে ভারত চার উইকেটে ১৯৯ রান করেছিল। এরপর রায়না এবং ভিভিএস মিলে ১০৫ রান যোগ করেছিলেন যা ভারতকে লিড নিতে সাহায্য করেছিল।
এছাড়া দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারত ১৭১ রানে পাঁচ উইকেট হারায়। এরপর আবারও দৃশ্যপটে ভিভিএস এবং রায়না; দুজনের ৮৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি ভারতকে সেদিন জয় এনে দিয়েছিল। নিজের প্রথম টেস্ট সিরিজের যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন রায়না সেটি ব্যাটার হিসেবে তাঁর গুরুত্বকেই প্রমাণ করে।
- ১০০ বনাম ইংল্যান্ড, ২০১৪
সাদা কোকাবুরা বল হাতে জেমস অ্যান্ডারসন, ক্রিস ওকস সেদিন ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপের শক্ত পরীক্ষা নিয়েছিলেন। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকা ভারত ১৩২ রান তুলতেই চারজন ব্যাটসম্যান বিদায় নেয়। এরপর সুরেশ রায়না আর এমএস ধোনির বোঝাপড়ায় নখদন্তহীন হয়ে পড়ে ইংলিশ বোলাররা।
সুনিপুণ সব কাট শট আর ড্রাইভ খেলে রায়না একাই তাণ্ডব চালিয়েছিলেন সেদিন। শেষ পর্যন্ত ক্রিস ওকসের বলে আউট হলেও তার আগেই যা করার করে ফেলেছিলেন। ভারতও সেদিন ম্যাচ জিতে নিয়েছিল ১৪৩ রানের বড় ব্যবধানে।
- ৩৬* বনাম পাকিস্তান, ২০১১
বিশ্বকাপ মানেই বাড়তি চাপ, তাই তো সাধারণ দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সেঞ্চুরির চেয়ে বিশ্বকাপের একটি ত্রিশ রানের ইনিংস বেশি গুরুত্ব পায়। তার উপর যদি প্রতিপক্ষ হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কেউ তাহলে সেই ইনিংসের মাহাত্ম্য সংখ্যায় ফুটিয়ে তোলা যায় না।
এমনই একটি মনে রাখার মত নক এসেছিল সুরেশ রায়নার ব্যাট থেকে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে রায়না আরও একবার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিলেন।
২০০ রানের আগেই স্বীকৃত ব্যাটসম্যানরা সবাই ফিরে গেলেও ক্রিজে ছিলেন রায়না। সেদিন ভারত তাঁর ৩৯ বলে ৩৬ রানের ইনিংসটির অবদানেই ২৬১ রানের পুঁজি গড়তে সক্ষম হয়। জবাবে পাকিস্তান ২৯ রানে হেরে গেলে পরিষ্কার হয়ে যায় রায়নার ৩৬ রানের গুরুত্ব। এই ইনিংসটি না খেললে হয়তো পাকিস্তান জিতে যেত, ঘরের মাঠে শিরোপা উৎসবও করা হত না ধোনিদের।
এখানেই শেষ নয়। রায়নার বায়না মেটানোর নজির আরও আছে। একই বিশ্বকাপে মানে ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৮ বলে ৩৪ রান, কিংবা পরের বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের সাথে ২৮৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১১০ রানের ইনিংসগুলো সুরেশ রায়নার সক্ষমতার বার্তা দিয়ে যায়।