এজবাস্টন ২০০৫, শেষ অংকে শতাব্দীর সেরা

নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ব্রেট লি। অপরপ্রান্তে প্রান্তে তিনি তখন ৪৩ রানে অপরাজিত। জয়ের জন্য দরকার আর মাত্র তিনটি রান। স্ট্রাইকে থাকা মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ সামলাতে পারলেন না স্টিভ হার্মিসনের শর্ট বল। ব্যাটে লেগে বলটা বেলুনের মত লাফ দিয়ে চলে গেল ইংলিশ উইকেটরক্ষক গ্যারেন্ট জোন্সের হাতে।

তীরে এসে তরী ডোবার শোকে ক্রিজেই বসে পড়লেন ব্রেট লি। কি এক অনবদ্য লড়াইটাই না তিনি লড়ছিলেন ব্যাট হাতে। কিন্তু, পারলেন না শেষ হাসি হাসতে। ইংল্যান্ডের সেই টেস্ট জয়ের নায়ক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ এগিয়ে এলেন। কাঁধে হাত রেখে ব্রেট লিকে কি একটা যেন বললেন।

ইংল্যান্ডের উৎসবের মঞ্চে কি একটা যেন আবেগের খেলা হয়ে গেল সেই সময়। অ্যাশেজ মানেই যেখানে এক বিন্দু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নয় – সেখানে শেষ অবধি জয় হল ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটেরই। দু’জনের সেই ছবিটা তোলা হয়ে রইলো ক্রিকেট সহমর্মিতার অধ্যায়ে।

একুশ শতকের এই টেস্ট এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে আছে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ আর ব্রেট লির ঐতিহাসিক ছবিকে কেন্দ্র করে। তবে, সহমর্মিতার নজীর ছাপিয়ে ২০০৫ সালের সেই বার্মিংহ্যাম টেস্টটা ছিল দু’দলের টেস্ট মানসিকতার চূড়ান্ত এক নমুনা। যেন পিকচার পারফেক্ট এক টেস্ট ম্যাচ।

টেস্ট শুরুর আগেই ব্যাকফুটে ছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় টেস্টকে সামনে রেখে এজবাস্টনে এক ওয়ার্ম আপ সেশনে রাগবি টাচ গেম খেলছিল অস্ট্রেলিয়া দল। গ্লেন ম্যাকগ্রাও ছিলেন সাথে। খেলার এক পর্যায়ে অসাবধানতাবশত: মাঠে রাখা একটা স্ট্রে বলে বা দিয়ে পরে যান। সাথে সাথে হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে, রিপোর্ট থেকে তাঁর ছেঁড়া লিগামেন্টের খবর পায় অজিরা। অ্যাশেজ থেকে ছিটকে পড়েন ম্যাকগ্রা।

ম্যাকগ্রাহীন অস্ট্রেলিয়ান বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ওভার প্রতি গড়ে ৫ এর উপর নিয়ে ৪০৭ রানের উড়ন্ত সূচনা করে  ইংল্যান্ড দল। জবাবে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ৮২ রানে ভর করে ৩০৮ রান তুলে প্রথম ইনিংস শেষ করে পন্টিং এর দল। দ্বিতীয় ইনিংসে শেন ওয়ার্ন আর ব্রেট লির আগুন ঝড়া বোলিংয়ে মাত্র ১৮২ রান তুলতে না তুলতেই স্কোরবোর্ডে কালি শেষ ইংলিশদের।

আসল লড়াইয়ের পর্দা তখন উঠতে চলেছে। অ্যাশেজ উত্তাপ তখনো বাকি অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে। ২৮২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত উইকেট পতন উপহার দেয় অজিরা। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ আর অ্যাশলে জাইলসদের স্পেলে কোন জুটিই যেন ঠিকমত টিকছিল না।

দলীয় ১৩৬ রানে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট জাইলসের বলে ক্যাচ তুলে দেন। অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ উইকেটের পতন। স্বীকৃত সব ব্যাটাররা ফিরে গেছেন সাজঘরে। ১৭৫ রানে অজিদের ৮ উইকেটের পতনে হাসিমুখ উঁকি দিচ্ছিল ইংলিশ শিবিরে।

কিন্তু আগের ইনিংসের ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের জন্য যম হয়ে ওঠা ওয়ার্ন আর লি’র এবারের পরিকল্পনা ছিল বোলারদেরও কুপোকাত করার। ব্রেট লি আর ওয়ার্ন মিলে যোগ করেন ৪৫ রান। পাশার দান পাল্টে যেতে শুরু করে। 

ধীর-স্থির ক্রিকেট উপহার দিয়ে ওয়ার্ন আউট হওয়ার আগে দলের তখনো দরকার আরো ৬২ রান। ২২০ রানে ফ্লিনটফের মারমুখী বলে ওয়ার্নের হিট আউট ইংলিশদের জয়ের প্রহর গোণাচ্ছিল কেবল। ফেরার আগে ওয়ার্ন করেন জরুরী ৪২ টি রান।

কিন্তু, তেঁতে উঠলেন ব্রেট লি; মাইকেল ক্যাস্প্রোউইকজের মত অনভিজ্ঞ-দূর্বল ব্যাটসম্যানকে নিয়েই ঠাণ্ডা মাথার ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যাটিং প্রান্ত আটকে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা বৃথা হয় ৬৪ ওভারের শুরুতে।

হার্মিসনের ফুলটস বলে দারুন ব্যাট চালিয়েও সিঙ্গেল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ব্রেট লিকে। পরের বলে রান এল না। জয়ের জন্য দরকার কেবল তিনটি রান। নার্ভ ব্রেকিং মোমেন্টে হার মেনে ওভারের তৃতীয় বলে শর্ট ডেলিভারিতে উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ক্যাসপ্রোভিচ ইতি টানেন এক অসম্ভব সম্ভাবনার।

দুই রানের হার নিয়ে অপর প্রান্তে অপরাজিত ৪৩ রানে স্তব্ধ ব্রেট লির স্মৃতি এখনো পুড়িয়ে বেড়ায় অজি সমর্থকদের। এজবাস্টনের মাঠে ইংল্যান্ডের উদযাপনে অনন্য এক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

দুই ইনিংসে দুই হাফ সেঞ্চুরি আর সাত উইকেট নিয়ে অ্যাশেজ কাঁপানো অলরাউন্ডার হয়ে ওঠেন ফ্লিনটফ।  অধিনায়ক মাইকেল ভন তাই বলেই দিয়েছিলেন, ‘ফ্রেডি ফ্লিনটফ অসাধারণ খেলেছে।’

অথচ, টেস্টটা শেন ওয়ার্নেরও হতে পারতো। দুই ইনিংস মিলে ১০ উইকেট আর ৪২ রানের একটা ইনিংস। কিন্তু, বিধাতা অন্য রকম ভেবে রেখেছিলেন এজবাস্টনের সেদিনটা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link