পাগলামি, বিতর্ক ও ফুটবল

ডিয়েগো ম্যারাডোনা, বল পায়ে তাঁর কারিশমা নিয়ে চাইলে পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা লেখা যায়, চাইলে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা বলা যায়। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করার পর যতগুলো বছর বেঁচে ছিলেন, নি:সংশয়ে বলা যেত, ‘ম্যারাডোনা, আহা, কী খেলোয়াড়!’

বল পায়ে এত অসামান্য সব কীর্তি গড়েছিলেন যে তিনি মুক হলেও কোনো ক্ষতি ছিলো না। তবে পায়ের মতো তার মুখও যখন সমান চলতো, তখন সেখানে আষ্টেপৃষ্ঠে বিতর্ক জড়িয়ে থাকতো। ম্যারাডোনা কিছু বলবেন – আর তা কোনো নতুন বিতর্ক ছড়াবে না – তা হতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে এই আর্জেন্টনাইন ফুটবল কিংবদন্তির দেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ পড়ে দেখুন, বিতর্কের রসদ পাবেন নিশ্চিত।

  • লিওনেল মেসির প্রসঙ্গে

আর্জেন্টিনার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জননন্দিত ফুটবলার এবং তাঁর সাবেক শিষ্য মেসিকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে ম্যারাডোনার প্রবল আপত্তি। তার মতে, ‘যে লোক ম্যাচ শুরুর আগে ২০ বার টয়লেটে যায়, সে আর যা-ই হোক, নেতা নয়।’ সাথে যোগ করেন, ‘মেসি ভালো, তবে সেরা নয়।’

  • ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো প্রসঙ্গে

এই পর্তুগিজ সুপারস্টারের ব্যাপারে ম্যারাডোনার অভিমত, ‘ক্রিশ্চিয়ানো আপনাকে একটি গোল দেবে এবং তারপর আপনার কাছে শ্যাম্পু বিক্রি করবে।’ তবে রোনালদো একজন আর্জেন্টাইন হলে তাঁর ভালো লাগতো বলেও জানান তিনি।

দুকূল রক্ষা করতেই কিনা, তিনি যোগ করেন, ‘যদিও মেসিকে আমার বেশি পছন্দ।’

  • মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রসঙ্গে

কঠোর সমালোচনায় তার জুড়ি মেলা ভার, আমেরিকান রাষ্ট্রপতিদের ব্যাপারে বলতে গিয়েও সে ভাবভঙ্গি-ই যেন বজায় থাকে। একবার যেমন বলেছিলেন, ‘বুশ একজন খুনী, তার চেয়ে বরং আমি ফিদেলের (কাস্ত্রো) বন্ধু হতে চাইবো।

এবারের মন্তব্য এলো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে, ‘ও (ট্রাম্প) তো একটা পাপেট।’

  • অত:পর পেলের প্রসঙ্গে

ম্যারাডোনা এবং পেলে, সর্বকালের সেরা দুই খেলোয়াড় হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। তবে অন্যকে সেরা বলে মানতে কিংবা অন্যজনের অভিমত গ্রহণে তাদের দুজনেরই যেন ঘোরতর আপত্তি। তাই, কিছুদিন আগে পেলের করা মন্তব্য, ‘মেসির চেয়ে নেইমার ভালো’ শুনে ম্যারাডোনা বলে বসেন, ‘মেসির চেয়ে নেইমার ভালো? ও (পেলে) তবে ভুল ওষুধ খেয়েছে।’

  • ফিফা ও আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) কর্তাদের প্রসঙ্গে

আর্জেন্টিনা ফুটবলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট ম্যারাডোনা, গোটা ফুটবল ফেডারেশন ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন। সেটাও স্বভাবজাত রসিক ঢঙেই, ‘আপনাকে আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনে একটা গ্রেনেড ছুড়তে হবে এবং আবার নতুন করে সবকিছু তৈরি করতে হবে।’

তার আক্রোশ থেকে রেহাই পাননি ফিফা প্রেসিডেন্টরাও। সাবেক প্রেসিডেন্ট জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি জোয়াও-য়ের ওয়েবসাইট থিফ.কমে (thief.com) ফোন দেবো।’

আরেক সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার তাঁকে ‘সন্তানসম’ স্নেহ করতেন বলে মন্তব্য করেন, ‘ও (ব্ল্যাটার) আমাকে বাচ্চার মতো ভালোবাসতো, কুকুরের বাচ্চার মতো।’

  • সাবেক আর্জেন্টাইন কোচ হোর্হে সাম্পাওলির প্রসঙ্গে

প্রাক্তন সেভিয়া বসের সাথে আর্জেন্টাইন মহাতারকার সম্পর্ক কখনোই ততটা ভালো ছিলো না। এবারে সাম্পাওলির টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘সবার ধারণা ছিলো, সাম্পাওলি কম্পিউটার এনেছে, ড্রোন এনেছে, ১৪ জন সহকারী এনেছে। কিন্তু ও কী আদৌ সাফল্য এনেছে!’

  • সিজার লুইস মেনোত্তি’র প্রসঙ্গে

সিজার লুইস মেনোত্তি ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারে এক হতাশার নাম। তাই আজও তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই মেনোত্তিকে ক্ষমা করবো না।’

  • ব্রাজিলিয়ান তারকা দানি আলভেসের প্রসঙ্গে

এই বিশ্বকাপ বিজয়ী একবার দানি আলভেসের ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘আলভেস এক ম্যাচে ২৮ টি ক্রস করতে চেষ্টা করেছিলো এবং এর মাঝে চারটি সাফল্যের মুখ দেখেছিলো, এতেই ওর মান বোঝা যায়।’

এবার সাক্ষাৎকারে আলভেস সম্পর্কে তো তিনি কোনো মন্তব্য করতেই রাজি হননি, ‘ওর যেখানে খেলার কথা, ও তো সেখানে খেলেই না। আমরা কি ওর ব্যাপারেই কথা বলবো? যদি, ওকে নিয়ে আরো বলতে বলেন, তাহলে আমি চলেই যাবো।

  • ডেভিড বেকহ্যামের প্রসঙ্গে

‘যদিও বেকহ্যাম সবসময়ই স্পাইস গার্লের সাথে খুব ব্যস্ত ছিলো, তবে এর মাঝেই ও ফুটবল খেলার সময় খুঁজে পেয়েছিলো’, রিয়াল মাদ্রিদ ও ইংল্যান্ডের সাবেক তারকার স্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে ম্যারাডোনা এমন রসিকতা করেছিলেন। ‘তবে, জাতীয় দলের প্রতি তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত’, ম্যারাডোনা যোগ করেন।

  • সার্জিও রামোসের প্রসঙ্গে

সার্জিও রামোসের সাথে তার ঝামেলা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ স্পষ্ট। এবারে যেমন ডিয়েগো গডিনকে সেরার তকমা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক হয়েছে! আর রামোস, রামোস করবেন না। গডিন এসেছে। আর কিচ্ছু জানি না, গডিনই সেরা।

  • রিয়াল মাদ্রিদ প্রসঙ্গে

হোসে মরিনহোকে টেনে, রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে সাবেক বার্সেলোনা তারকা বলেন, ‘মরিনহো আসার পূর্বে, রিয়াল তো একটি বেশ্যালয় ছিল।’

  • সাবেক স্পেন ও রিয়াল কোচ হুলেন লোপেতেগুই প্রসঙ্গে

২০১৮  বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে, হুলেন লোপেতেগুইয়ের রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে চুক্তি করাটা ম্যারাডোনা কিছুতেই মানতে পারছেন না। ফিফার এই দূত বলেন, ‘এটা হতে পারে না লোপেতেগুই। তুমি তোমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছিলে। সেখানে গিয়ে একটা ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করাটা… নাহ, সম্ভবই না!’ লোপেতেগুই অবশ্য বেশিদিন মাদ্রিদেও টিকতে পারেননি।

  • ভিসেন্তে দেল বস্কের প্রসঙ্গে

স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপ, ইউরোর মতো গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা জয়ের পরও, দেল বস্ক ম্যারাডোনার সুদৃষ্টি কাড়তে পারেননি। তার মতে, ‘তিনি (দেল বস্ক) আরও অনেক কিছুই দিতে পারতেন।’

  • পিটার শিলটনের প্রসঙ্গে

সাবেক ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় কিংবা দুঃস্মরণীয় মুহূর্ত বলা যেতে পারে, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের সেই ‘হ্যান্ড অব গড’কে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতেই কিনা, ম্যারাডোনা আজও রসিকতা করেন, ‘শিলটন, তোমায় একটা গোপন কথা বলছি। আমি মাথা নয়, হাত দিয়ে গোল করেছিলাম।’

  • গণমাধ্যম প্রসঙ্গে

সাংবাদিকদের সাথে তাঁর দা-কুমড়ো সম্পর্ক কারোরই অজানা নয়। সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর বিরক্তি ফুটে উঠলো আরেকবার, এ কথায়, ‘যদি জাতীয় দলের কোচ হয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে হয়, তবে আমি সে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবো।’

  • গীর্জা প্রসঙ্গে

ধর্ম-ও তার আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। তিনি বলেন, ‘যখন আমি ভ্যাটিক্যানে গেলাম, সেখানে কেবলই স্বর্ণের জিনিস দেখতে পেলাম, রাগে-ক্ষোভে যেন আমি আগুনের গোলার মতো জ্বলছিলাম।’

  • সমকামিতা প্রসঙ্গে

বিতর্ক এবং ম্যারাডোনা যেন হাতে-হাত রেখেই এগোয়। এবারে যেমন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, তিনি কখনো সমকামীদের কারণে সমস্যায় পড়েছিলেন কিনা! উত্তরে তিনি জানান, ‘আমি সমকামীদের বিরুদ্ধে? কোনো উপায় নেই।’

তবে তিনি ম্যারাডোনা বলে কথা। তাইতো জুড়ে দেন, ‘এটা ভালো যে পৃথিবীতে তারা আছেন। এতেই যে আরও কিছু নারীকে ফ্রি পাওয়া যায়!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link