ডি বক্সের ভিতর বল পেলেন জে জে ওকোচা সামনে গোল পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে আসা অলিভার কান। একটা ফেক শট মেরে বলটা বামদিক থেকে ডান দিকে নিলেন ওকোচা কিন্ত কানকে বোকা বানানো কি এতোই সোজা, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন এই গোলরক্ষক। এবার আবার শট নিলেন ওকোচা, কান মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গোল আটকাবার জন্য, কিন্ত না এটাও ফেক শট! বল যে এখনো তাঁর পায়ে।
এরপর বল নিয়ে ড্রিবলিং করে ডি বক্সে থাকা প্রতিপক্ষের বাকি তিন খেলোয়াড়কে কিছুক্ষণ নাকানি চুবানি খাওয়ানোর পর অলিভার কানকে আবারো পরাস্ত করে এক বুলেট শটে বল পাঠিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষের জালের ভিতর।
ক্যারিয়ার জুড়েই নিজের ড্রিবলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে বোকা বানানো এই ফুটবলার ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট নাইজেরিয়ার এনুগু রাজ্যের রাজধানী এনুগু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অগাস্টিন আজুকা ওকোচা যাকে লোকে জে জে ওকোচা নামেই চেনে অন্য সব আফ্রিকান ফুটবলারদের মতই রাস্তায় খেলেই তার ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। তবে সবসময় যে ফুটবল পেতেন ব্যাপারটা তাও না, বিবিসি স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই তারকা বলেছিলেন, ‘যত দূর মনে পরে গোল আকৃতির কোন কিছু পেলেই আমরা সেটা দিয়ে খেলতাম, আর ফুটবল পেলে সেটা ছিল বোনাস।’
ওকোচার প্রফেশনাল ফুটবলার হওয়ার গল্পটা অন্য সব তারকা ফুটবলারদের থেকে আলাদা। স্থানীয় দল এনুগু রেঞ্জার্সের হয়ে ভাল খেললেও বড় কোন দল বা একাডেমির স্কাওটদের নজরে তিনি কখনই পড়েননি। ১৯৯০ সালে তিনি জার্মানিতে যান বন্ধু বিনেবি নুমার সাথে দেখা করতে। এছারাও আরেকটি কারণ ছিল জার্মান লিগের খেলা দেখা, কিছুদিন আগেই ১৯৯০ ‘র বিশ্বকাপ জেতা জার্মানি জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় নিজ দেশের লিগেই খেলতেন তাই জার্মান লিগ ওকোচাকে আকৃষ্ট করে।
ওকোচার বন্ধু জার্মান তৃতীয় বিভাগের দল বুরুশিয়া নয়েনকিরসেনে খেলতেন। সেখানে এক সকালে বন্ধুর দলের ট্রেনিং সেশন দেখতে উপস্থিত হন তরুণ ওকোচা, এসময় তাকেও বন্ধুর সাথে যোগদানের জন্য আহবান জানায় ক্লাবের ট্রেনিং স্টাফ। দুর্লভ এই সুযোগ কাজে লাগান ওকোচা, মাঠে তার সামর্থের পুরোটাই ঢেলে দেন যা দেখে দলটির ম্যানেজার মুগ্ধ হন এবং তাকে নিজেদের দলে যোগদানের প্রস্তাব দেন। শুরু হয় ইউরোপিয়ান ফুটবলে আফ্রিকান এই জাদুকরের পথচলা।
জার্মান লিগের তৃতীয় বা দ্বিতীয় বিভাগে খেলার খেলোয়াড় তিনি ছিলেন না তা প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, জার্মানির নিচু ডিভিশনে মাত্র দুই বছর কাটানোর পর ১৯৯২ সালে প্রথম বিভাগের দল আইনট্র্যাক্ট ফ্রাঙ্কফুর্টে তিনি যোগ দেন। প্রথম থেকেই সমর্থক, ফুটবল বিশ্লেষক সবার দৃষ্টি কাড়েন। ১৯৯৩ সালে ফ্রাঙ্কফুটের হয়ে কার্লসরুহের এস সির বিপক্ষে খেলার সময় অলিভার কানকে বিপর্যস্ত করে এক গোল করেন যা আজো বুন্ডেসলিগার অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়, উপরে এই গোলেরই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের আফ্রিকান ফুটবল অ্যাওয়ার্ড শোতে গোল অফ দা ইয়ার অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার সময় ওকোচা অলিভার কানের বিপক্ষে করা তার আলোচিত গোল নিয়ে মুখ খোলেন, বলটা এতক্ষণ ধরে পায়ে রাখার কোন ইচ্ছাই নাকি তার ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমি এতক্ষণ বলটা নিজের পায়ে রাখতে চাই নি, গোলটা হওয়ায় আমি খুশি হয়েছিলাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি সময় নিয়েছিলাম গোলটা করার জন্য কিন্ত গোলটা না হলে যে কি হতো তা আমি কল্পনাও করতে চাই না।’
ক্লাসিক নাম্বার ১০ রোলে খেলতেন ওকোচা, তার ফাস্ট ড্রিবলিং এবং বল ডিসট্রিবিউশন দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত। সেই সময়ের দর্শকরা তথা ৯০’র দশকে তারা এমন খেলোয়াড় আগে দেখেন নি। প্রশ্ন উঠতেই পারে পেলে কিংবা ম্যারাদোনা তাহলে কি করত? আসলে পেলে কিংবা ম্যারাডোনারা ছিলেন ভিন্ন ধর্মী ড্রিবলার তারা মুলত ছিলেন চেঞ্জ অব পেসের শিল্পী কিন্তু ওকোচা করতেন ফাস্ট ড্রিবলিং, দৌড়ের গতি না কমিয়েই দেখাতেন পায়ের জাদু পরবর্তীতে রোনালদিহো বা হাল আমলের নেইমার, সালাহ, হ্যাজার্ডদের সাথে যার তুলনা হতে পারে।
চার মৌসুম জার্মানিতে কাটানোর পর ১৯৯৬ সালে ফ্রাঙ্কফুট যখন রেলিগেটেড হয়ে জার্মান দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যায় তখন তিনি তুরস্কের ক্লাব ফেনেরবাচেতে যোগদান করেন। দুই মৌসুম তুরস্কে কাঁটিয়ে ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের পারিস সেইন্ট জারমেইনে যোগদান করেন। পিএসজিতে ২০০২ সাল অবধি ছিলেন তিনি এবং এখানেই তরুণ রোনালদিনহো তার দেখা পান। রোনালদিনহোর কাছে তিনি কি ছিলেন তা তার ২০১৭ সালের ৯ মে তে করা এক টুইট দেখলেই বোঝা যায়। টুইটে রোনালদিনহো বলেন যে ওকোচা এবং ভালদেরামা হলেন নাম্বার ১০ রোলে খেলা সেরা খেলোয়াড় যারা তাকে অনুপ্রানিত করেছিল।
২০০২ সালে তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল বোলটন ওয়ান্ডারার্সে যোগদান করেন। এসময় তার নাম নিয়ে একটা কৌতুক চালু হয়, ‘জে জে এতো ভাল খেলোয়াড় যে তার দুইবার নামকরণ করা হয়েছে।’ সমর্থকরা জার্সির পেছনে এই কথাগুলো লিখে স্টেডিয়ামে তার খেলা দেখতে আসতো। ইপিএলেও তিনি তার জাদু দেখাতে ভোলেননি, প্রতিপক্ষ এবং সমর্থক উভয়ই অপেক্ষায় থাকত কখন ওকোচা তার তেলেসমাতি কারবার দেখাবেন।
২০০৬ সালে বোলটন ছেড়ে তিনি কাতারে পাড়ি জমান, কাতার এস সি তে এক মৌসুম খেলার পর ২০০৭ সালে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের দল হাল সিটিতে যোগ দেন। পুরো মৌসুম জুড়েই ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করে মাত্র ১৮ ম্যাচ খেলেন তিনি। মৌসুম শেষে হাল সিটি প্রিমিয়ার লিগে প্রোমোশন পেলেও তাকে ক্লাব থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয় আর এর পরই তিনি বুট জোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে নাইজেরিয়া জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে খেলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে আইভরি কোস্টের বিপক্ষে মাঠে নেমে তার অভিষেক হয় আর ২০০৬ সালে আফ্রিকান কাপ অফ নেসন্স খেলে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানান । ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে গোল্ড জয়ী নাইজেরিয়া দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
২০১৬ সালে নাইজেরিয়ান ফুটবলার জোসেফ ইয়োবোর টেস্টিমনিয়াল ম্যাচ খেলতে আবারো বুটজোড়া পরে মাঠে নামেন ওকোচা। প্রায় আট বছর আগে অবসর নিলেও পায়ের জাদু যে একটুও কমে যায়নি তা তার চোখ ধাঁধানো পারফরমেন্স দেখে খুব সহয়েই বোঝা যায়। ম্যাচের ২৩ মিনিটের সময় প্রতিপক্ষ দলে খেলা স্যামুয়েল ইতো মজা করে ওকোচাকে বদলি করার জন্য কোচের প্রতি ইঙ্গিত করেন এবং দুই জনই হাসতে থাকেন।
বর্তমান ফুটবল থেকে ক্লাসিক নাম্বার টেন পজিশনটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। ইউরোপের টপ ক্লাব গুলোর কাছে স্কিলফুল ফুটবলারদের চাইতে এখন অ্যাথলেট টাইপের ফুটবলারদের চাহিদাই বেশি। তাই ইউটিউবে জে জে ওকোচার ড্রিবলিং গুলো দেখে খালি হতাশ হতে হয়, সামনে হয়ত এধরনের ফুটবলার আর দেখাই যাবে না কারণ ক্লাসিক নাম্বার টেন পজিশনের সাথে সাথে এই ধরনের খেলোয়াড়রাও যে আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে।