মাঠে এলেন, চোখের নিচে কাল রঙের দু’খানা স্টিকার লাগিয়ে। এসে আম্পায়ারের সাথে খানিক কথা সেরে স্ট্যাম্পের পজিশন ঠিক করে নিলেন। এরপর তুলে নিলেন বেল। ব্যাটের হাতল দিয়ে গেড়ে নিজের ব্যাটিং স্ট্যান্সের চিহ্ন ঠিক করে নিলেন। তবে শুধু যে তিনি সে কাজটুকুই করেন তা বলা মুশকিল। তিনি যেন গেড়ে দেন ব্যাটিংয়ের ভিত। শিবনারায়ণ চন্দ্রপাল ব্যাট হাতে বাইশ গজে নামা মানেই যেন দেয়াল উঠে যাওয়া।
শিবনারায়ণ চন্দ্রপাল জন্মেছিলেন ১৬ আগস্ট ১৯৭৪ সালে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের গায়ানা নামক দ্বীপরাষ্ট্রে জন্ম তাঁর। ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাঁর বাবা খেমরাজ চন্দ্রপাল ছিলেন পেশায় জেলে। তবে তিনি টুকটাক ক্রিকেট খেলার সাথেও ছিলেন সম্পৃক্ত। সেখানকার স্থানীয় ক্লাবের সাথেও সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর।
সে ক্লাবের কারণেই মূলত শিবনারায়ণ চন্দ্রপলের ক্রিকেটে আসা। জেলে পল্লী থেকেই উত্থান ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং দেওয়ালের। ক্লাবের ব্যাটাররা একটা লম্বা সময় ধরেই ছিলেন রান খরায়। আর তা দেখেই নিজের ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর ব্রত নিয়ে ফেলেছিলেন শিবনারায়ণ চন্দ্রপলের বাবা খেমরাজ। এরপর তো হলো ইতিহাস। ক্রিকেটের সমৃদ্ধ ইতিহাসের এক সুন্দর অধ্যায় হয়ে রয়ে গেলেন চন্দ্রপাল।
ব্রায়ান লারাকে তো আর নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। আর সেই ব্রায়ান লারার শূন্যস্থান পূরণের জন্য একজনকে ছিল খুব প্রয়োজন। সে জায়গাটাই যেন দখল করে ফেলার একটা প্রচেষ্টা করে গিয়েছিলেন চন্দ্রপল। তবে বিশ্বজুড়ে একটা সুখ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের খানিকটা অদ্ভুত ব্যাটিং স্ট্যান্সের জন্য। স্কোয়ার লেগের দিকে মুখ করে তিনি ব্যাটিং করতেন। তবে এতে করে দুর্গ হতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি তাঁর।
তিনি বরং অমন ভিন্নধর্মী ব্যাটিং স্ট্যান্সেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতেন। ভিন্নতার জয়গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক অদম্য যোদ্ধা। ক্রিকেট মাঠের যোদ্ধা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধুঁকতে থাকা ক্রিকেটের এক নীরব পাথেয়। তিনি যে কোন কিছুতেই দমে যাবার পাত্র নন, সে প্রমাণ তো রেখেছিলেন ২০০৮ সালে জামাইকাতে। সেবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলছিল ক্যারিবিয়ানরা।
ব্রেট লি’র একটা বল সপাটে আঘাত হানে চন্দ্রপলের হেলমেটে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন স্কোরবোর্ডে শিবনারায়ণের নামের পাশে ৮৬ রান। পরিস্থিতি বেশ বেগতিক। একটা পর্যায় মনে হচ্ছিল তাঁকে হয়ত স্ট্রেচারে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে মাঠের বাইরে। তবে না, তিনি গেলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, খানিকবাদে দৌঁড়ালেন। তিনি ছুঁটে গেলেন শতকের দিকে। এভাবেই হার না মানা যোদ্ধাদের মতই লড়াই করে গিয়েছেন বাঁ-হাতি এই ব্যাটার।
তেমন করেই তিনি টেস্টে প্রায় ১২ হাজার রান করেছিলেন। আর ওয়ানডেতেও প্রায় নয় হাজার রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। অথচ তাঁকে ভাবা হত একজন নিতান্ত সাধারণ টেস্ট মেজাজের ব্যাটার। কেননা এখনও টেস্টে সর্বোচ্চ রান তাঁরা করে জেতার রেকর্ডে চন্দ্রপালের নামটি জুড়ে রয়েছে। ২০০৩ সালে অ্যান্টিগা টেস্টে ৪১৮ রান চেজ করে জিতেছিল ক্যারিবিয়রা। তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
তবে তিনি হয়ত বাইশ গজে এসে খানিক সময় নিতেন। পিচের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্ট করতেন। এরপর নিজের দৃষ্টিনন্দন সব শট খেলতেন। তাই বলে যে তাঁর ওয়ানডে পরিসংখ্যান আড়াল করা দায়। তিনি সেখানটায় ৭০ এর বেশি স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করে গিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ার জুড়ে। দুই যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি ভরসার এক প্রতীক ছিলেন। দ্বীপ রাষ্ট্রটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পারফর্ম করেও লাইমলাইট ও তাঁর মাঝে ছিল এক অভেদ্য পর্দা।
তবে যাই হোক। পরিসংখ্যানে তিনি বাকি সবার চাইতে এগিয়ে। ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭৫০টি পার্টনারশিপের একপ্রান্তের ধ্রুবক মান ছিলেন শিবনারায়ণ চন্দ্রপল। রাহুল দ্রাবিড়ের সংখ্যাটা ৭৩৮। এই প্রথম স্থানের বিপরীত এক বিচিত্র গল্পের শেষ উদাহরণেও রয়েছেন তিনি। শিবনারায়ণ চন্দ্রপল ও তাঁর ছেলে তেজনারাইন চন্দ্রপল একসাথেই ব্যাট করতে নেমেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাচে গায়ানার হয়ে।
বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের ইতি তিনি টেনে নিয়েছেন। হয়ত অপেক্ষায় আছেন একদিন তাঁর মত করেই তাঁর ছেলে তেজনারায়ণ ধরবে ক্যারিবিয়ার ক্রিকেটার হাল।