বেলফাস্টের অন্ধকার ঘরে ল্যাম্পের এক চিলতে আলো জ্বেলে টেলিফোনের ডায়াল টেবিলটা বেশ কয়েকবার ঘোরালেন এক ভদ্রলোক। অপরপ্রান্তে ফোনটা ধরা হলে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হলো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের উদ্দেশ্যে একটি টেলিগ্রাম যাবে, টেলিগ্রামের ভাষাটা নিজেই ঠিক করে দিলেন, ‘I think I’hv found a genius for you।’
যিনি টেলিফোনটা করেছিলেন, তাঁর নাম বব বিশপ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রবাদপ্রতিম স্কাউটার, বেলফাস্টে এসেছিলেন স্কাউটিংয়ের জন্য। অপরপ্রান্তে ফোনটি কে ধরেছিল তা জানা নেই, কিন্তু ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের যে মানুষটির উদ্দেশ্যে টেলিগ্রামটি করতে বললেন, তিনি আর কেউ না – দ্য গ্রেট ম্যাট বাসবি, জন্মলগ্নের পর থেকে রেড ডেভিলদের প্রথম স্বপ্নের পথ দেখানো বাসবি বেইবসদের কারিগর।
আর জিনিয়াসটি কে? পেলের মতে ‘ইউরোপের সেরা’, ম্যারাডোনার মতে, ‘অনুকরণীয় আদর্শ’। ভুল পথে পা বাড়িয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে স্বল্পস্থায়ী করে তোলা এক বিশ্বকাপও না খেলা বিশ্বজয়ী, যাঁর মৃত্যুর ঠিক আগে বলে যাওয়া শেষ বাক্য ছিল – ‘Don’t Die Like Me’। এক নাম না জানা ‘ফিফথ বিটল’, যার জন্মের তারিখটাও মনে রাখে না কেউ – দ্য গ্রেট জর্জ বেস্ট।
বিশপের হাত ধরে তিনি পা রেখেছিলেন ম্যানচেস্টারে। কিন্তু তাতে কি হবে, তিনি যে অত্যন্ত ঘরকুনো। চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই বন্ধু ম্যাকমের্ডির সাথে ম্যানচেস্টার থেকে সটান পাড়ি দিয়ে দিল সেই বেলফাস্টে। যাই হোক, বাবার হস্তক্ষেপে অনেক বুঝিয়ে তাকে আবার ইংল্যান্ডে ফেরানো হয়। শুরু হলো ‘বাসবি বেইবস’-এর নতুন অধ্যায়।
গল্পটা এগিয়ে নেওয়ার আগে একটু ম্যানচেস্টারের কথা বলে রাখি। বার্লিন দুর্ঘটনার পর ম্যানচেস্টারের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বেস্ট আসার সময়ে, বিগত পাঁচ বছরে কোনো ট্রফি নেই। তখন প্রিমিয়ার লিগে শুধুই লিভারপুল, নিউক্যাসলদের রমরমা। আর সর্বক্ষণের সাথী ছিল লিভারপুল সমর্থকদের বিদ্রুপ। এবার চলুন, আসল গল্পে ফেরা যাক।
‘ওই ছোকরা, একটু দাঁড়াও এখানে। একটু ভালো করে দেখি তোমাকে। গোটা ম্যাচে শুধু তোমার পিঠটা দেখতে পেয়েছি, যেটা টাচলাইনের ওপর ওঠানামা করছিল শুধু’ – কথাটা বললেন ওয়েলেসের ডিফেন্ডার গ্রাহাম উইলিয়ামস। সেটা ছিল সতেরো বছরের সেই ‘জিনিয়াস’এর ম্যানচেস্টার অভিষেক। বিপক্ষে ওয়েলেস। ম্যাচটায় কোনো গোল পাননি, কিন্তু কতটা প্রভাব ছিল, সেটা মাপতে হয়তো উইলিয়ামসের বক্তব্যটাই যথেষ্ট।
এভাবেই শুরু হলো লাল জার্সির ‘বিটল’ এর পথচলা। বেস্ট-ববি চার্লটন-ডেনিশ ল’র ত্রিভুজ তখন ইউরোপ কাঁপাচ্ছে। লম্বা ঝাঁকরা চুলের সুদর্শন বেস্টের নয়নাভিরাম খেলায় মুগ্ধ হতে থাকল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের দর্শক। ম্যানচেস্টারে একটা কথা খুব প্রচলিত – ‘In every Saturday, people pay not to watch Goals, but to watch Beautiful Football in Old Trafford।’
সত্যিই, গোলই তো শেষ সৌন্দর্য নয়। শেষ সৌন্দর্য ফুটবলের পায়ে পায়ে ঘোরা সেই মহাজাগতিক স্কিলের মাদকতা যা দর্শককে বসিয়ে রাখতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা, গোল না হবার পরেও। আর জর্জ বেস্ট যেন রেড ডেভিলদের সেই চাহিদার বেশি কিছু দিয়ে বসল। সুদর্শন বেস্টে মুগ্ধ হয়ে গোটা ইউরোপ সেই সময়কার বিখ্যাত ‘বিটলস’ ব্যান্ডের সুদর্শন চারজন গায়কদের অনুসারে তার নাম দিল ‘ফিফথ বিটল’।
সত্যি, বেস্ট ফুটবল নয়, সঙ্গীত নিয়ে খেলতেন যেন। দেখতে দেখতে ৬৬’এর ইউরোপা কাপের কোয়ার্টারে মুখোমুখি ম্যানচেস্টার আর বেনফিকা। সেই সময়কার শক্তিশালী বেনফিকা। ইউসেবিওর বেনফিকা। আগের লেগে পিছিয়ে থাকা ম্যানচেস্টারের বিদায় যখন সবাই ধরে নিয়েছে, তখনই জ্বলে উঠল ‘বাসবি বেইবস’। ৫-২ গোলে কার্যত পর্যুদস্ত করল ইউসেবিওদের। কিন্তু সেবার বেস্ট চোট পাওয়ায় ইউরোপা কাপ অর্থাৎ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হলো না ইউনাইটেডের।
এরপর সোজা চলে আসুন ১৯৬৬/৬৭ মৌসুমে। বেস্টের ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ পর্যায়। সেবার আবারো ইউরোপা কাপের ফাইনালে বেনফিকা আর ইউনাইটেড। নব্বই মিনিট অবধি স্কোর ১-১। এমন সময় পোস্টের পঁচিশ গজ আগে বল পেয়ে একজন,দুইজন, তিনজনকে কাটিয়ে আগুয়ান গোলরক্ষককে ডজ করে জালের উদ্দ্যেশ্যে বল ঠেলে দিয়ে দু হাত তোলা উচ্ছ্বাসে মাতলেন জর্জ বেস্ট।
সেই গোলের পর দাঁড়াতে পারেনি বেনফিকা। তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। ইতিহাসে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ এলো রেড ডেভিলসদের ট্রফি ক্যাবিনেটে। সেবার ব্যালন ডি ওরটাও এসেছিল বেস্টের দখলে। আমার জ্ঞান অনুযায়ী তিনিই একমাত্র যে বিশ্বকাপ না খেলেও বিশ্বসেরা হয়েছিলেন।
কাট টু ১৯৭৬। তখন গোটা বিশ্বে ইয়োহান ক্রুইফ নামের এক ব্যক্তির রমরমা।দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টোটাল ফুটবলের দর্শন।এমনসময় আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের এক ম্যাচের আগে সাংবাদিক বিল এলিয়ট প্রশ্ন করে ফেললেন জর্জ বেস্টকে, ‘কে সেরা আপনি না ক্রুইফ?’
বেস্টের সোজা সাপটা জবাব, ‘শিশুসুলভ প্রশ্ন। দেখবেন এই ম্যাচেই আমি ক্রুইফকে নাটমেগ করবো, তাও প্রথম সুযোগেই।’
যেমন বলেছিলেন, কাজেও করে দেখান। ম্যাচের প্রথম সুযোগেই নাটমেগ করেছিলেন বেস্ট। ফুটবলের লজিকে নাটমেগটা নেহাতই একটা ড্রিবল নয়, কিছুটা অপমানও। ম্যাট বাসবি একবার বলেছিলেন, ‘তুমি বেস্টকে কোচিং করাতে যেও না, ওকে নিজের মতো থাকতে দাও।’
বাসবি চলে যাবার পর এই সূত্রটা হয়তো পরবর্তী কোচেরা মেনে চলেননি। তাই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ম্যানচেস্টার, কিন্তু তা সত্ত্বেও বেস্টের শ্রেষ্ঠত্ব একটুকুও হ্রাস পায়নি। এমনও হয়েছে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা বেস্ট (২৬), আর তারপরে ম্যান ইউয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ডেনিশ ল’র গোলসংখ্যা মাত্র নয়টা।
কিন্তু ম্যানেজারদের সাথে ক্রমাগত ঝামেলা মাত্র ২৮ বছর বয়সেই ফর্মের শীর্ষে থেকে অবসর নিয়েছিলেন বেস্ট। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অসংযমী জীবন, একাধিক নারীসংযোগ। কিন্তু, এসব ব্যাপারে তাঁর মতো উদাসীন তারকা আরেকজনকেও দেখিনি। একবার বলেছিলেন, ‘১৯৬৯ সালে আমি নারী আর মদ ছেড়ে দিই। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে ২০ মিনিট।’
একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মিস ব্রিটেনসহ একাধিক নারীর সাথে সংযোগ নিয়ে কি বলবেন? তিনি বলেছিলেন, ‘But I missed a lot, Miss Canada Miss Universe Miss World।’ আসলে ফুটবলের ব্যাপারে তিনি বরাবরই উদাসীন। অবসর নেবার পর পরিযায়ী পাখির মতো বিভিন্ন দেশে একটু-আধটু ফুটবল খেলে বেরিয়েছেন, কিন্তু প্রতিটাই খুবই স্বল্পক্ষণের পিরিয়ড।
এক উজ্জ্বল তারকার পরিসমাপ্তি এভাবেই হয়েছিল। না হলে হয়তো পেলে, ম্যারাডোনা বা ক্রুইফের সাথে তাঁর নামটা একইসাথে উচ্চারিত হতো। কিন্তু এ নিয়েও কোনো আক্ষেপ তার মধ্যে দেখা যায়নি। তিনি এও বলেছিলেন, ‘লিভারপুলের বিরুদ্ধে ত্রিশ গজ দূর থেকে করা গোল আর মিস ওয়ার্ল্ডের সাথে পরিভ্রমণের অপশন দিলে কোন অপশনে যাব সেটা বলা খুবই কঠিন।’
সময়টা ২০০২ কি ৩। অত্যন্ত মদ্যপানে তার লিভারসহ মাল্টি অর্গান ফেলিওর হয়। তাঁর লিভার মাত্র কুড়ি শতাংশ কাজ করছিল, কিন্তু তারপরেও মদ্যপান একটুও কমাননি।
তিন বছর পর, তখন রাত একটা। ক্রমওয়েল হাসপাতালে মারা যান জর্জ বেস্ট। হয়তো মৃত্যুর ঠিক আগে কিছুটা হলেও আক্ষেপ হয়েছিল নিজের জীবন নিয়ে, মারা যাবার আগে শেষবার বলে গেলেন, ‘Don’t Die Like Me!’
বেস্ট কোথায় সেরা? ফুটবল ক্যারিয়ার বিচার করলে ব্যাপারটা অনেক বিতর্কিত। কিন্তু মন দিয়ে বিচার করলে ষাটের দশকে অবনমিত ম্যান ইউয়ের পতাকা তুলে ধরবার একজন লোকের অভাব ছিল, বেস্ট সেই লোকটা। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের বস্তি, যেখানে তারকার অভাব, সেখান থেকে বিশ্বকাপ না খেলেও ব্যলন ডি’অর জেতা একজন উদাসীন তারকার নাম বেস্ট।
তিনি তার প্রতিভার পঞ্চাশ শতাংশও ব্যবহার করেছেন কি না সন্দেহ। জানি না, বাকি পঞ্চাশ এলে কি হতো! এ প্রসঙ্গে বেস্টেরই একটা উক্তি মনে পড়ে, ‘আমি দেখতে কুৎসিৎ হলে লোকেরা পেলের নামও জানতো না।’
অনেকে এই উক্তির সাথে পেলেকে বর্ণবিদ্বেষমূলক শ্লেষের অভিসন্ধান পেয়েছিলেন। কিন্তু, ব্যাপারটা আসলে অন্য। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, অত্যধিক সুদর্শন হওয়াতে একাধিক নারীর প্রস্তাবে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি, তা না হলে তাঁর নাম পেলের আগেই থাকতো। অহংকার? নাহ, আসলে তা নয়।
একবার মোহাম্মদ আলীর আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে সাংবাদিক বলেছিল বইয়ের নাম,‘আলী-দ্য গ্রেট।’ মোহাম্মদ আলী নাম পরিবর্তন করে রাখতে বলেছিলেন – ‘আলি-দ্য গ্রেটেস্ট’। এ ব্যাপারে পরে আলী বলেছিলেন, ‘আমার মতো কেউ সেরা হলে, তার পক্ষে বিনয়ী হওয়াটা খুব কঠিন।’
বেস্টের ব্যাপারেও এই একই সূত্র। তা না হলে ক্রুইফকে বলেকয়ে নাটমেগ করেন। মাঝে মাঝে আফসোস হয়,সত্যি এমন প্রতিভার সাথে যদি একটু ডিসিপ্লিন আর ডিটারমিনেশন যুক্ত হতো, তবে বেলফাস্টের বাসিন্দাদের মতো হয়তো আমরাও বলতাম- ‘Maradona good, Pele Better, George BEST।’ কিন্তু এতো কুৎসা এবং অতিস্বল্প ক্যারিয়ারের পরেও ওয়ার্ল্ড সকারের রিপোর্ট অনুযায়ী একশ জন সর্বকালের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে বেস্টের স্থান সপ্তম। এখানেই তো তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব!
একটা পুরোনো আফ্রিকান প্রোভার্ব খুব মনে পড়ে যায়, ‘Rain can soak leopard’s skin, but can’t wash out the spots।’ আর তাইতো বার্লিন এয়ার ক্র্যাসের পরেও রেড ডেভিলসরা শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। এতোকিছুর পরেও জর্জ বেস্ট নামটা ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়েই রয়ে গেছে। প্রথম, দ্বিতীয়তে না হয় পেলে-ম্যারাডোনারাই থাক।