অথৈ সাগর। সেই সাগরে আটকে পড়া এক ছোট্ট তরী। এত পানি তবুও সুপেয় পানিটা যেন মিলছে না। ভারতীয় ক্রিকেটের পরিস্থিতি যেন ঠিক তেমনই। খেলোয়াড় ঠাসা একটা পাইপলাইন। অনায়াসে দুই-তিনটা আন্তর্জাতিক মানের দল একটা সময়েই গড়ে ফেলা সম্ভব। তবুও কেন যেন শিরোপা এসে দেয় না ধরা।
এমনটা হবার কারণও রয়েছে বেশ। এবারের এশিয়া কাপকেই বিবেচনায় নেওয়া যাক। শুরুর আগেই খানিকটা হোঁচট। চোটের কারণে দলে নেই প্রধান পেস অস্ত্র জাসপ্রিত বুমরাহ। তাঁকে ছাড়াই আরব আমিরাতে ভারত দল। প্রথম ম্যাচটা এক চিলতে ফাঁকা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় তাঁদের। পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় রোহিত শর্মার দল। তবে সেটা সে জয়টা কেবলই এক ‘ফ্লুক’।
সুপার ফোর রাউন্ডের গুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচেই হারতে হয়েছে ভারতকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ হারা ছাড়াও অপ্রাত্যাশিত হার ‘আন্ডারডগ’ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা টুর্নামেন্টের দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই নিয়ে নেয় টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়। এর পেছনে নানান রকম কারণ থাকতে পারে। তবে খালি চোখে যে কারণটা সবার আগে সামনে আসতে পারে সেটা হচ্ছে সলিড একটা দল নির্বাচন না করা।
ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট বেশ দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে ছিল প্রায় প্রতিটা ম্যাচ শুরুর আগে। কাকে রেখে কাকে খেলাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই। সে কারণেই প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই ছিল কোন না কোন পরিবর্তন। মূল সমস্যাটা বেঁধে অবশ্য একজন অভিজ্ঞ এবং পরীক্ষিত পেসারের অভাবে। তাঁর পরিবর্তে ভারতকে ধুঁকতে হয়েছে বোলিং ডিপার্টমেন্টে। তাছাড়া স্থির একটি একাদশ না থাকায় খেলোয়াড়দের নিজেদের রোল নিয়েও ধোঁয়াশার মুখে পড়তে হয়েছে।
টিম কম্বিনেশনের অভাবটাও সৃষ্টি হয়েছে ঋষাভ পান্ত ও দীনেশ কার্তিক দুই জনকে দলে জায়গা করে দিতে গিয়ে। তাছাড়া বোলিং ডিপার্টমেন্টে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবি বিষ্ণই দুই বোলারকে নিয়েও দোদুল্যমান অবস্থানে ছিল টিম ইন্ডিয়ার টিম ম্যানেজমেন্ট।
একাদশের রসায়নটা থিতু হবার সময়টুকু পাওয়া যায়নি। সেটা বেশ মস্ত বড় এক কারণ হিসেবেই সামনে এসেছে। তাছাড়া বোলিং আক্রমণের বোলারদের পরিকল্পনার অভাবটাও স্পষ্ট। আবেশ খান, আর্শদ্বীপ সিং আর ভুবনেশ্বর কুমারকে নিয়ে গড়া পেস অ্যাটাকের অভিজ্ঞতার পাল্লাটা ভারী। সেই সাথে পুরো টুর্নামেন্টেই আবেশ যেন ছিলেন পথহীন পথিক। বাড়তি ঝামেলা হিসেবে হাজির তাঁর অসুস্থতা।
সে সময় আবার হার্দিক পান্ডিয়াকে ব্যবহার করা হয়েছে মূল পেস বোলার হিসেবে। সেটার মাশুলও দিতে হয়েছে ভারত দলকে। এক ভুবনেশ্বর কুমার হয়ত উইকেট পেয়েছেন, তবে তিনিও যে খুব একটা কার্যকর ছিলেন সেটা বলার সুযোগ নেই। দলকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে পারেননি। অন্যদিকে তরুণ বোলাররা নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণটাও করতে পারেননি। প্রচণ্ডরকম আঘাত সইতে হয়েছে তাঁদের। সেটাও ভারতের শিরোপা ধরে রাখতে না পারার পেছনের অন্যতম কারণ।
তাছাড়া ভারতের আরও একবার টুর্নামেন্টে ভরাডুবির কারণ পাওয়ার হিটিং বিষয়টার অভাব। ভারতের ওপেনারদের মধ্যে রান তোলার তেমন একটা তাড়া দেখা যায়নি। ঠিক তেমন মনোভাব যেন সম্পূর্ণ দলের মাঝেই বিস্তার ঘটেছে। দলের অন্যতম হার্ডহিটার ব্যাটার হার্দিক পান্ডিয়াও নিজেকে মেলে ধরার সুযোগটা পাননি। মিডল অর্ডারে ভারতের দ্রুত রান তোলার প্রবণতার ঘাটতিও ছিল বেশ।
সুরিয়াকুমার যাদব বেশকিছু ম্যাচে নিজের সক্ষমতার ঝলক দেখালেও, সে আলো খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মোদ্দা কথা এসব কারণেই ভারতের এমন ব্যর্থতার গল্প আরও একবার লেখা হয়ে গেল। তবে দল নিয়ে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণ সম্ভবত বড় কোন লক্ষ। আর সেটা যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চে একটা ‘সলিড টিম’ নিয়েই হাজির হতে হবে ভারতকে। সেটা নিশ্চয়ই বোঝে টিম ম্যানেজমেন্ট।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দল ঘোষণা করে ফেলেছে ভারতের নির্বাচকরা। এখন বাকি কাজটা টিম ম্যানেজমেন্ট ও অধিনায়কের। সামনে থাকা দুই দ্বিপাক্ষিক সিরিজে একটা স্থিতিশীল একাদশ নিয়েই মাঠে নামতে হবে অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে। বিশ্বকাপের আগে অন্তত আর তেমন কোন খেলোয়াড়কে নতুন করে বাজিয়ে দেখার সুযোগ নেই।