১৯৯৯, ওয়াসিম আকরাম ও বার্মিংহ্যাম লিগ

ওয়েস্ট ব্রমউইচ ডার্টমাউথের রব ফেনটন ওয়াসিম আকরামের কথা কখনো ভুলবেন না। ভুলতে পারবেন না অভিষেক ম্যাচের ১৫ মিনিট পর মাঠে পৌঁছানো সেই ঘটনাকে। পাকিস্তানি পেসারের বাউন্সার সামলাতে গিয়ে এই ব্যাটারের চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনটি দাঁতও হারাতে হয় তাঁকে।

ঘটনার সময়কাল ১৯৯৯ সাল। ওয়াসিম আকরাম তখন পৌঁছে গেছেন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। অবশ্য ততদিনে নিজের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের একজন হিসেবে। ওয়ানডে এবং টেস্ট দুই ফরম্যাটেই নিয়ে ফেলেছেন তিন শতাধিকের বেশি উইকেট। কিন্তু সে সময়টা ছিল বড় টালমাটাল, ফিক্সিং এর জেরে পাকিস্তান ক্রিকেটে চলছে পালাবদল।

সেলিম মালিক মূল অভিযুক্ত হলেও অধিনায়ক আকরাম এবং ইজাজ আহমেদও ছিলেন সন্দেহের তালিকায়। এমতাবস্থায় কাউন্টি থেকে নিজের নাম সরিয়ে আকরাম নাম লেখায় বার্মিংহ্যামের স্থানীয় লিগে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কিংবদন্তি অবসরের আগেই খেলছেন ইংল্যান্ডের স্থানীয় লিগে ব্যাপারটা হজম করতে সে সময় কষ্টই হয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। অবশ্য নিজের ক্যারিয়ারকে আরো দুই-তিন বছর দীর্ঘায়িত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি, চাপমুক্ত হয়ে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন খেলাটাকে। 

স্মেথউইক ক্রিকেট ক্লাবের ইতিহাসে অবশ্য আকরামই প্রথম তারকা ক্রিকেটার নন! তিনি ক্লাবের জার্সি গায়ে জড়ানোর প্রায় সত্তর বছর আগেই খেলে গেছেন সিডনি বার্নস। এছাড়া মাস কয়েক আগেই বিশ্বকাপ ফাইনালে টস করতে যার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন আকরাম, সেই স্টিভ ওয়াহও স্মেথউইকের হয়ে খেলেছিলেন তিন ম্যাচ।

আকরামের স্মেথউইকে খেলার সব বন্দোবস্ত করেছিলেন রাজা খান, যিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা এবং ক্রিকেটারদের কাছের লোক। মূলত তিনিই ম্যাচ প্রতি দুই হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে রাজি করান। টাকার অংকটাও সেই সময় বিবেচনায় মন্দ ছিল না।

ওয়াসিম আকরামের চুক্তি হবার পর অবশ্য চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল বার্মিংহ্যাম লিগের বাকি দলগুলোর ব্যাটসম্যানরা। আকরামকে কিভাবে সামলাবেন এই ভেবে রাতের ঘুম হারাম হবার জোগাড় হয়েছিল তাদের। স্থানীয় পত্রিকাগুলো দারুণ এক সংকলন বের করেছিল কি করে তারা আকরামকে এড়াতে পারেন। সেই তালিকায় ছিল অন্য ডিভিশনের কোনো ক্লাবে চলে যাওয়া, ক্রিকেট বাদ দিয়ে গলফ শুরু করা, ম্যাচের সময়ে আদালতে চলে যাওয়া, চেস্ট গার্ড কিনে ফেলা কিংবা নিজের উইল করে রেখে ফেলার মতো মজার সব ব্যাপার। 

ওয়াসিম আকরামের অবশ্য সেবারই প্রথম ইংল্যান্ডে আসা নয়। দশ বছর আগেও তিনি একবার খেলতে এসেছিলেন এই বিলেতে। তখন অবশ্য ক্রিকেটের মহীরুহ হয়ে ওঠেননি, সদ্য কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দিয়েছেন। পাকিস্তানের তখনকার অধিনায়ক ইমরান খানই সেবার তাকে সুযোগ করে দেন বার্নোপফিল্ডের হয়ে খেলার। সাপ্তাহিক ৫০০ পাউন্ডের হয়ে খেলার চুক্তিতে সেবার তাদের হয়ে আট ম্যাচে নিয়েছিলেন ২৮ উইকেট। পরে তো জাতীয় দল কিংবা কাউন্টি দলের হয়ে রাজত্ব করেছেন ইংল্যান্ডের সব বিখ্যাত মাঠেই। লর্ডস, ওভাল কিংবা ট্রেন্টব্রিজ সব খানেই ভীতি ছড়িয়েছেন প্রতিপক্ষ শিবিরে।

নিজের প্রথম ম্যাচে খেলা শুরুর নির্ধারিত সময়ে মাঠেই পৌঁছাতে পারেননি ওয়াসিম আকরাম। নিজের ধারাভাষ্য, বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং সেরে যখন রওয়ানা দেন খেলার উদ্দেশ্য ততক্ষণে ম্যাচ শুরু হয়ে যাবার উপক্রম। ভাগ্যিস সেই ম্যাচে টস জিতেছিলেন স্মেথউইক অধিনায়ক আসিফ দিন।

টস জিতে ব্যাটিং নেয়াতে আকরামের দেরিতে পৌঁছানো খুব একটা সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ১২৯ রানে তিন উইকেট পড়ে গেলে ব্যাট করতে নামেন এই তারকা। এসেই স্লগ সুইগ করে বল পাঠান সীমানার বাইরে। স্মেথউইক তাদের ইনিংস শেষ করে ২৪৭ রানে। তারপরই সময় আসে বল হাতে ওয়াসিম আকরামের আগুন দেখবার।

প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ব্রমউইচের ব্যাটিং অবশ্য মোটামুটি ভালোই ছিল। ওপেনিং এ নামতেন ওয়াগ এবং মার্ক রিন্ডেল। ওয়াগ তার ক্যারিয়ারে  প্রায় সাড়ে বারো হাজারের মতো রান করেছিলেন আর র‍্যান্ডেল ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটার। এমনকি আফ্রিকার হয়ে ওয়াসিম-ওয়াকারের পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরিও ছিল তার। চারে নামতেন রিচার্ড ডাল্টন, যিনি ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে মারকুটে ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিলেন।

অবশ্য ওয়াসিম আকরামের তাতে থোড়াই কেয়ার, তিনি তো একজনই। তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি ক্রিকেট ইতিহাসের মহিরুহ সব ব্যাটম্যানরা। প্রথম স্পেলে বোলিং করতে এসেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ব্রমউইচের টপ অর্ডার, চার উইকেটের সবগুলোই নিয়েছিলেন। তার বাউন্সার আর ইয়র্কারের ছোবলে পায়ের পাতা এবং চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের। 

ওয়াসিম আকরাম দুই মৌসুমের ছোট ছোট কিছু সময় স্মেথউইকের হয়ে খেলেন। তাতে অবশ্য গল্প করার মতো স্মৃতি জমে আছে বার্মিংহ্যামবাসীর কাছে। শুরুতে বলা রব ফেনটনের কথাই ধরুন না, নিজের চোয়াল ভেঙে যাওয়া ভুলে গিয়ে এখনো স্মরণ করেন ওয়াসিম আকরামের মহত্ব। ভুলতে পারেন না ম্যাচ শেষে তাকে দেখতে আসা আকরামকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link