সময়টা ১৯৪৪। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তর-অধ্যায়। নাৎসি জার্মানির কাছ থেকে পোল্যান্ড পুনর্দখল করেছে সোভিয়েত সেনারা। শুরু হয়েছে তাদের যথেচ্ছ অত্যাচার। আর সব থেকে বেশি যেটা ছিল, তা হল গণধর্ষণ। আট থেকে আশি–সমস্ত নারীরা হতে লাগল সোভিয়েত সেনার লালসার শিকার। এক এক জনকে পনেরো বারেরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা এখনও উল্লেখিত হয় বিভিন্ন রিপোর্টে। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট গেল স্বয়ং স্ট্যালিনের কাছে। অবশেষে ৪৭’ এ প্রতিষ্ঠিত হল নতুন পোল্যান্ড রিপাবলিক।
সিলিসিরা অঞ্চল। পোল্যান্ডের এক ছোট্ট ডোমেইন। সেই সিলিসিরার দম্পতি-জোসেফ আর বারবারা জেজ ঠিক করল দেশত্যাগ করবে তাঁরা। কমিউনিস্ট পোল্যান্ডে তাদের মন টিকলো না। তাঁরা পাড়ি দিল সুদূর ফ্রান্সে। সেখানেও তাঁদের হাঁড়িতে কালি পড়ল না বেশিদিন। তাঁদের মন পড়েছিল জার্মানির দিকে। কারণ সিলিসিরা অঞ্চলটি বিশ্বযুদ্ধের আগে ছিল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত, সেই সূত্রে তারা জার্মান।
কাজেই পোল্যান্ডের বাসিন্দা হলেও জার্মানির প্রতি আকর্ষণ তাঁদের টানছিল ক্রমাগত। রক্তের টান যাকে বলে।বিশ্বযুদ্ধের পরে একটা নিয়ম জারি হয়েছিল, কোনো মানুষ যদি নৃতাত্ত্বিকভাবে অন্য দেশের বাসিন্দা হয়, তবে তাঁর সেই দেশে যাওয়ায় কোনো বাঁঁধা নেই। সেই হিসাবে নৃতাত্ত্বিকভাবে জার্মান জোসেফ-বারবারা দম্পতি পাড়ি দিল জার্মানিতে। আর সঙ্গে গেল তাদের আট বছরের ছোট্ট ছেলে।
কিছু বছর পর।
ফ্রিডল্যান্ড। বার্লিনের দক্ষিণ পূর্বের এক মফস্বল। সেখানে বসেছে ফুটবল ক্যাম্প। ক্যাম্পে অনেক জার্মান কিশোরের সাথে যোগ দিয়েছে জোসেফ-বারবারার সেই ছোট্ট ছেলেটিও, তখন বয়স ষোলো। কিন্তু জার্মান ভাষার ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নেই তার। জানে মাত্র দুটি জার্মান শব্দ – ‘Ja’ আর ‘Nein’। ইংরেজি করলে দাঁড়ায় – ‘Yes’ আর ‘No’।
কাজেই বেশিরভাগ সময়েই তাঁকে অঙ্গভঙ্গি করেই কাজ চালাতে হয়। ফুটবলকে সিরিয়াস প্রফেশন হিসেবে নেবার কোনো লক্ষ্য তার মধ্যে ছিল না। আসলে সে ছিল দ্বিধাগ্রস্থ, যদি ফুটবল নিয়ে বেশিদূর এগোতে না পারে, তাহলে তো একূল ওকূল দুকূলই যাবে। কাজেই ফুটবলের পাশাপাশি সে শিখছিল কারপেন্টারের কাজ।
ষোলো বছর বয়সে জার্নিম্যান হবার ফাইনাল পরীক্ষা দিল। পরীক্ষায় পেল ১০০ তে ৯৯। সুবিধার্থে বলে রাখি জার্নিম্যান হল জার্মানির পেইড কারপেন্টার। ছেলেটা তখন গ্রামের এক ক্লাবেই খেলে। ক্লাবটা ছিল জার্মানির সপ্তম ডিভিশনের একটা ক্লাব। তখনও সে একাধারে ফুটবলার একাধারে কারপেন্টার।কিন্তু এভাবে আর কতদিন। দু’নৌকায় পা দিয়ে তো আর বেশিদিন চলা যায় না।
ততদিনে তার স্কোরিং অ্যাবিলিটি সারা ফেলে দিয়েছে জার্মানিতে। অবশেষে দ্বিধাবিভক্ত হওয়া ভাগ্যের রাস্তা থেকে একটা রাস্তা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে গেল, আর সুস্পষ্ট উজ্জ্বল হয়ে রইল ফুটবলার হবার রাস্তাটা, যখন এস জি ব্লাডব্যাশ থেকে তাকে ট্রান্সফার করা হল এফ সি হামবুর্গে। সে তখন বুঝে গিয়েছে, কারপেন্টার নয়, ফুটবলটাই লেখা আছে তাঁর ভাগ্যে। ছেড়ে দিল কারপেন্টারের কাজ। আর একমাত্র পেশা হিসাবে বেছে নিল সকারজগতের চর্মগোলককে। কে জানত,সেদিনের তার এই সিদ্ধান্তটা কালো-লাল-হলুদ পতাকাটাকে করবে উজ্জ্বলতম।
সময়টা ২০০০ সাল। পোল্যান্ডের কোচ জেরি অ্যাঙ্গেল গিয়েছে তার কাছে। জন্মসূত্রে পোলিশ সেই স্ট্রাইকারটি ততদিনে সারা ফেলেছে বুন্দেশলিগায়। অবশ্য এফ সি হামবুর্গের হয়ে বেশিদিন সে খেলতে পারেনি। সেখান থেকে কাইজারস্লাটার্নে গিয়েই আত্মপ্রকাশ করে প্রলিফিক স্কোরার হিসাবে। পোলিশ কোচ জেরি অ্যাঙ্গেল তাই তার কাছে নিয়ে এসেছিলেন পোল্যান্ডের হয়ে খেলার প্রস্তাব।
উত্তরে সেই স্ট্রাইকার বলেছিলেন, ‘আমি জার্মান পাসপোর্টের মালিক। খেলতে হলে তাই রুডি ফোলারের দলেই খেলব।’ জন্মসূত্র নয়, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কেই সেদিন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর জার্মানি পেয়ে গিয়েছিল তাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্কোরারকে – ‘দ্য সাল্টা ক্লজ’ মিরোস্লাভ ক্লোসা।
হিসেব মত একবছর পরেই জার্মানির হয়ে অভিষেক হল তার। দিনটা ২৪ মার্চ। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের একটা ম্যাচ।প্রতিপক্ষ আলবেনিয়া। ম্যাচের ৭৩ মিনিটে বদলি হিসাবে নেমে করলেন নিজের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল আর জার্মানির হয়ে একটা ম্যাচ জেতানো গোল।
আর গোলের পর সেই বিখ্যাত ফ্রন্ট ক্লিপ সেলিব্রেশন। এরপর দু’দুটো হ্যাট্রিকের ফলে সুযোগ পেয়ে গেলেন ২০০২-এর বিশ্বকাপ দলেও। সেখানেও সৌদি আরবের সাথে করলেন হ্যাটট্রিক। তারপর আরও দুটো ম্যাচে গোল এল। তাজ্জব ব্যাপার এটাই, এই পাঁচটা গোলই এসেছিল তার হেড থেকে, এটাও একটা রেকর্ড।
আর এরপরেই জার্মানিতে ছড়াতে শুরু করল সেই বিখ্যাত প্রচলিত কথাটা- ক্লোসা গোল করলে জার্মানি হারে না। তাঁর গোলের পর সেই বিখ্যাত সমারসল্ট সেলিব্রেশনে মজেছে গোটা জার্মানি। জার্মান ভাষায় ডিগবাজিকে বলা হয় ‘সাল্টা’। আর সান্টা ক্লজের সাথে মিল রেখে জার্মানরা তাকে ডাকতে শুরু করল নতুন নামে – সাল্টা ক্লজ, জার্মানদের সান্টা ক্লজ।
কাট টু ২০১৪ বিশ্বকাপ। ঘানার সাথে জার্মানির ম্যাচ চলছে। পরিবর্ত হিসেবে নামেন ক্লোজে। সেই ম্যাচেও সেই প্রচলিত স্লোগানটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গোল পেয়েছিলেন ক্লোসা, জয় পেয়েছিল জার্মানি। তৈরি হল নতুন বিশ্বরেকর্ড। ব্রাজিলের রোনালদো ‘দ্য ফেনোমেনন’-এর সাথে যুগ্মভাবে ক্লোসা হলেন বিশ্বকাপের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
পরের দিনই রোনালদোর কাছ থেকে এসেছিল সেই বিখ্যাত টুইটটা, ‘এখানেই থেমে যাও।’ থেমে যাননি ক্লোজে। সেই ব্রাজিলের বিপক্ষে সেমিতে গোল করেই ভেঙেছিলেন সিনিয়র রোনালদোর রেকর্ডটা। একটা-দুটো নয়, বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে ১৬ গোলের বিশ্বরেকর্ড!
১৯৯৪ এর সেই ১৬ বছর বয়সী কারপেন্টার আর ২০১৪ এর সেই বিশ্বজয়ী সাল্টাক্লজের মাঝে রয়ে গিয়েছে কুড়িটা বছর। রয়ে গিয়েছে কত কত স্মৃতি। হামবুর্গ থেকে কাইজারস্লাটার্ন কিংবা ব্রেমেন থেকে বায়ার্ন – তাঁর মাথা কথা বলেছে বারবার। বায়ার্নে যেদিন গিয়েছিলেন,সেই দিনই বায়ার্নে যোগ দিয়েছিল আরও দুইজন – ফ্র্যাঙ্ক রিবেরি আর লুকা টনি। তাদের তিন জনকে থাকতে হয়েছিল একই রুমে।
একজন ফরাসী, একজন ইতালিয়ান, একজন জার্মান। ভাষা নয়, মূলত অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমেই তারা একে অপরের ভাব বুঝত। একসাথে তারা রেস্টুরেন্টে যেত। ক্লোসা বসত রেস্টুরেন্টের ধারঘেঁষে, আবার লুকার পছন্দ ছিল মাঝের সিটটা। এখনও সেইসব স্মৃতিতে বিগলিত ক্লোসার হৃদয়। কিন্তু লুই ভান গাল বায়ার্নের দায়িত্ব নিয়েই লুকা আর ক্লোসার সাথে কেমন যেন বিমাত্রিসুলভ আচরণ করতে থাকে।
ক্লোসাকে সব ম্যাচে খেলাতেন না, খেলালেও বদলী হিসেবে। তাই বায়ার্ন থেকে ক্লোসা পাড়ি দিলেন ইতালিতে, লাজিওতে। পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্স, সেখান থেকে জার্মান, আবার তার পরে ইতালি – বারেবারে স্থান বদলেছে তাঁর জীবনের। কিন্তু বদলায়নি জার্মানির সাদা জার্সির হয়ে তার সেই হেডে করা গোলের ধারাবাহিকতা। তাই তো ক্লাব সার্কিটে তেমনভাবে রেকর্ড না করা ক্লোসা দেশের হয়ে করে গেলেন একাত্তরটি গোল।
জার্মানির সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার কে? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনাদের কাছে আসবে অনেকগুলো নাম – জার্ড মুলার, ক্লিন্সম্যান, পোডোলস্কি, ওয়াল্টার, উয়ে সিলার – আর এসব হেভিওয়েটের মাঝে আমরা কখন যেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার নাম নিতেই ভুলে যাই। একগুচ্ছ হেভিওয়েট স্কিলফুলদের মাঝে একজন মিরোস্লাভ ক্লোসার সার্থকতা কোথায়?
আসুন দেখে নিই -তখন ম্যাচ চলছে লাজিও আর ন্যাপোলির মধ্যে। ক্লোসার হাতে লেগে একবার বল ঢুকেছিল জালে।তিনি পারতেন মিথ্যে বলে গোলের ভাগীদার হতে, ম্যাচটাও জিতে যেত লাজিও। কিন্তু তাঁর বদলে রেফারির কাছে স্বীকারোক্তি দিয়ে এলেন বলটা তার হাতে লেগেছে, কাজেই গোল নয়। ম্যাচের পর বলেছিলেন, ‘রেফারি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল এটা গোল কি না। আমি রেফারিকে হ্যাঁ বলতে পারতাম। কিন্তু অনেক ইয়াংস্টারের কাছে আমরা রোল মডেল। তাই আমি চাইনি সততার জায়গাটা নষ্ট হোক।’
এখানেই তো সার্থক ক্লোসা। ক্লিন্সম্যান, জার্ড মুলারদের মত হেভিওয়েটদের ভিড়ে এখানেই যে জিতে গিয়েছেন একজন মিরোস্লাভ।জিতে গিয়েছে তার জার্মান রক্ত।
২০১৪ বিশ্বকাপ চলাকালীন একবার আমার বন্ধু বলেছিল, বিশ্বকাপ জিতলে ক্লোসার সার্কেলটা পূর্ণ হবে। কিন্তু, সার্কেলটা তো সেদিনই পূর্ণ হয়েছিল, যেদিন ন্যাপোলির সাথে সেই ম্যাচটায় ক্লোসা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সূদূর পোল্যান্ড থেকে সৎ জীবনের উদ্দেশ্যে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো জোসেফ-বারবারার রক্তের ঋণ।
কারণ সোনার মেডেল নয়, সততাতেই যে মুক্তি। সোনার কাপ পাবার আগেই কখন যে সাল্টা ক্লজ সততা আর বিশ্বাসে সান্তা হয়ে গিয়েছেন, ইতিহাস তা বুঝতেই পারেনি। কারণ ইতিহাস ট্রফির হিসেব নিয়ে গিয়েছে, ফেলে গিয়েছে মনুষ্যত্বের হিসেবটা।