সেবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে রোহান কানহাইয়ের ২৫৬ রানের সুবাদে ক্যারিবীয়রা শেষ করে ৬১৪ রানে। জবাব দিতে নেমে ক্যারিবীয় পেস ব্যাটারির তোপের মুখে পড়ে ভারত। ওয়েসলি হল আর রয় গিলক্রিস্ট মিলে ভারতকে গুটিয়ে দেন ১২৪ রানে।
আসলে সেই সময়টাতে স্ব-ছন্দে পেস বোলিং খেলতে পারার মতো ভালো ব্যাটসম্যান ছিল না ভারতের। দ্বিতীয় ইনিংসেও ১৭ রানে চার উইকেট পড়লে ইতিহাসের সর্বনিম্ন রানের শংকায় পড়ে স্বাগতিকরা। ভারতের এই লজ্জাজনক পরিণতিতে যেন অহমিকায় ঘা লাগে একজনের। আকারে ছোটখাটো গড়নের এই ব্যাটার মাঠে নেমেই শুরু করেন ভয়ডরহীন ব্যাটিং।
কখনও রয় গ্রিলক্রিস্টকে পুল করছেন, আবার কখনও নান্দকীয় কাভার ড্রাইভে সীমানা ছাড়া করেন। তিনি যেন পণ করেই নেমেছেন বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। শেষ পর্যন্ত ভারত সেদিন হার এড়াতে পারেনি। কিন্তু তাঁর ৫৮ রানের ইনিংস প্রশংসিত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। ক্যারিবীয় পেসব্যাটারির সামনে এমন একার লড়াই যে খুব বেশি দেখেনি বিশ্ববাসী। তিনি বিজয় মাঞ্জরেকার, সুনীল গাভাস্কারের আগমণের পূর্বে ভারতের ব্যাটিংয়ের ত্রাণকর্তা।
বিজয় মাঞ্জরেকারের বেড়ে ওঠা ক্রীড়াপ্রেমী পরিবার থেকেই। তাঁর দূর সম্পর্কের চাচা দত্তরাম হিন্ডেলকারও ভারতের হয়ে চারটি টেস্ট খেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁর ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত হয়নি। তাঁর ছেলে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার মাঠে নেমেছেন ভারতের হয়ে। ৯২ টেস্ট খেলা সঞ্জয় অবশ্য বর্তমানে বেশি জনপ্রিয় তাঁর ধারাভাষ্যকার হিসেবে ভূমিকার জন্য।
আকারে ছোটখাটো গড়নের হলেও পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ছিলেন দারুণ স্ব-ছন্দ। বিশ্বের সেরা সব পেসারদের সামলেছেন বুক চিতিয়ে। তাঁর সময়ে ভারতীয় ব্যাটাররা যেখানে হেলমেট ছাড়া হুক করতে ভয় পেতেন, সেই সময়টাতে তিনি হুক শট খেলে গিয়েছেন নির্দ্বিধায়। ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক তাঁর। অভিষেক ম্যাচেই ছয়ে নেমে ৪৮ রান করে জানান দিয়েছিলেন নিজের আগমনী প্রতিভার।
তবে কুঁড়ি হতে ফুল হয়ে ফোটা বোধহয় পরের বছর, ভারতের ইংল্যান্ড সফরের সময়। সেটাই ছিল বিদেশের মাটিতে তাঁর প্রথম সফর। প্রথম ম্যাচেই লিডসে ফ্রেড ট্রুম্যান, অ্যালেক বেডসার, জিম লেকারদের সামলে খেলেন ১৩৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। অধিনায়ক বিজয় হাজারের সাথে গড়েছিলেন ২২২ রানের জুটি। তা সত্ত্বেও সে ম্যাচ হেরে গিয়েছিল ভারত। তবে ব্যাট হাতে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে, নিউজিল্যান্ডের ভারত সফরের সময়। সেবার প্রায় ৭৭ গড়ে সিরিজ শেষ করেন ৩৫৬ রান নিয়ে।
দলের বিপদে প্রতিবারই ত্রাণকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বিজয়। মুম্বাইতে তাঁর ৫৯ এবং ৩৯ রানের উপর ভর করেই অস্ট্রেলিয়াকে নিজেদের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় বারের মত হারিয়েছিল ভারত। কিংস্টনে একবার আলফ ভ্যালেন্তাইনকে সামলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১১৮ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস।
সেবার পংকজ রায়ের সাথে ২৩৭ রানের জুটি গড়ে দলকে বাঁচিয়েছেন বড় হারের মুখ থেকে। ব্যাটের পাশাপাশি ডান-হাতি অফস্পিনটাও ভালোই করতেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিশ উইকেট নিলেও আন্তর্জাতিক পেয়েছিলেন কেবলমাত্র একটি উইকেট। কিউই ব্যাটসম্যান নেইল ম্যাকগ্রেগরকে আউট করা সেই ডেলিভারিটি মাহাত্ন্য বুঝা যাবে যখন জানা যাবে ১৯৫৫ সালের দিল্লী টেস্টে সেটাই ছিল নিউজিল্যান্ডের একমাত্র উইকেট পতন।
পাশাপাশি উইকেটরক্ষক হিসেবেও ছিলেন দারুন পটু। দলের প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে যেতেন উইকেট সামলাতে। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় অবশ্য ফিটনেসজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তা সত্ত্বেও রানে কখনও ভাটা পড়েনি, ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টেও হাঁকান দারুণ এক সেঞ্চুরি। আজকের মারকাটারি টি- টোয়েন্টির যুগে যেখানে টেল এন্ডারদেরও ছয় হাঁকাতে জানতে হয় ,সেখানে বিজয় পুরো ক্যারিয়ারে কোনো ছয় না মেরেই করেছেন তিন হাজারের বেশি রান।
বিশ্বসেরা পেসারদের সামলানোর পাশাপাশি স্পিনটাও বেশ ভালোই খেলতেন মাঞ্জরেকার। তাঁর মতো দারুণ কাট শট ভারতে খুব কম ব্যাটসম্যানই খেলতে জানতেন। রঞ্জি ট্রফির সেমিতে একবার ভগবত চন্দ্রশেখর, এরাপল্লি প্রসন্নদের মতো স্পিনারদের সামলে খেলেছিলেন ১৭৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।
সেই ম্যাচের পিচ এতটাই স্পিননির্ভর ছিল, স্পিনার নিজেও জানতেন না বল কোনদিকে বাঁকবে। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে টিকতেই পারছিলেন না, সেখানে নির্দ্বিধায় কাট করে গিয়েছেন বিজয়। সেই ম্যাচের পর প্রসন্ন বলেছিলেন, ‘গাভাস্কার + বিশ্বনাথ = বিজয় মাঞ্জরেকার। গাভাস্কারের ফুটওয়ার্ক আর বিশ্বনাথের স্ট্রোক এ দুয়ের সম্মিলন কেবল মাঞ্জেরেকারেই ব্যাটেই সম্ভব।’ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই স্পিনারের উক্তিই বুঝিয়ে ব্যাটসম্যান হিসেবে কতোটা উঁচু মানের ছিলেন তিনি।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালে মাদ্রাজে পরলোকগমন করেন এই ক্রিকেটার। ভারতের ইতিহাসে হয়তো অসাধারন ব্যাটসম্যান এসেছেন, কিন্তু বিজয় মাঞ্জরেকারের মতো দলের বিপদে বুক চিতিয়ে লড়াই করার মতো সাহস খুব কম ক্রিকেটারই দেখাতে পেরেছেন।