তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটাকে বল ছুড়ে দিতেন বাবা। আর ছেলেটা প্লাস্টিকের ব্যাট দিয়ে সজোরে মারত।
এক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি বলতেন, শক্ত করে ব্যাটের হ্যান্ডেল ধরবে। আর যত জোর শরীরে আছে, তত জোরে বলটা মারবে। সেই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির নাম ভিভ রিচার্ডস। ক্রিকেটের সহজ পাঠ এভাবেই শিক্ষার্থীদের দিতেন ভিভ।
তিন বছরের ছেলেটা ভিভকে চিনত না। জানতও না। নিজেই প্লাস্টিকের ব্যাটটা শক্ত করে চেপে ধরে জোরে বল মারত। তখন কি আর কেউ ভেবেছিল এ ছেলের জন্যই একদিন দেশের রিংটোন হবে, বিরাট কোহলি খেললে ভারত জেতে।
১৯৯৮ সালের শারজাহ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মরণবাঁচন ম্যাচ ভারতের। জাতীয় দলের কোচ অংশুমান গায়কোয়াড় টিম মিটিংয়ে বলে উঠলেন, ‘একজন কাউকে বড় রান করতেই হবে।’
দলের খর্বকায় মারাঠী বললেন, চিন্তা করবেন না স্যার, আমি সেঞ্চুরি করব।” শারজায় সেই ম্যাচ চলাকালীন মরুঝড় উঠেছিল। তার পরে সেই খর্বকায়ের ব্যাট হয়ে উঠল গাণ্ডীব। মরুঝড়ের থেকেও প্রবল আরেক ঝড় উঠেছিল সেদিন। সবাই বলেছিলেন ‘শচীন ঝড়’। ভারতকে ফাইনালে তুলে বাসে ফেরার সময়ে আবার সেই মারাঠী বলে উঠেছিলেন, ‘স্যর দেখবেন কালও সেঞ্চুরি করব।’ কথা রেখেছিলেন মুম্বাইকর। ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করে তবেই থেমেছিলেন তিনি।
মারাঠীর খেলা বাবার সঙ্গে বসে দেখেছিল ওই ছোট্ট ছেলেটা। কী জাদু কে জানে মারাঠীর খেলায়! ওই বাচ্চা ছেলেটার পৃথিবী বদলে গেল এক নিমেষে। তার চিন্তাভাবনায় ঢুকে গেল ক্রিকেট। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধুই ক্রিকেট।
দিল্লীর ছোট্ট গলিতে ক্রিকেট খেলত বাচ্চা ছেলেটা। পাড়ার বড়দের সঙ্গে খেলতে একটুও ভয় পেত না। জোরে শট মারত। বলের আঘাতে কত বাড়ির কত জানালা ভেঙেছে তার ইয়ত্তা নেই। বয়স্ক ছেলেগুলো পালিয়ে যেত বকা খাওয়ার ভয়ে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা ক্রিকেটকে এতটাই ভালবাসত যে স্টাম্প ছেড়ে, ব্যাট ফেলে রেখে পালাতে পারত না। সে যে পালিয়ে যাওয়ার ছেলেই নয়। পড়শিদের কাছে ধরা পড়ে যেত। বকুনি জুটত। তবুও ক্রিকেট ব্যাট ছাড়ত না। ওটাই যে ওর প্রাণের আরাম।
উইকেটের অন্য প্রান্ত থেকে একের পর এক উইকেট চলে যেতে থাকে এখন। দমে যায় না ছেলেটা। সবাই চলে যেতে পারে আউট হয়ে, বিরাট কোহলি আউট হতে পারেন না। ওঁর আউট হতে নেই। গোটা দেশের শ্বাসপ্রশ্বাসে বিরাট কোহলি।
বাবা একদিন ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন অ্যাকাডেমিতে। তখন নয় বছর বয়স হবে। ১৫ বছর বয়সের ছেলেগুলোর সঙ্গে সমানে যুঝে যেত ছেলেটা। একদিন একটা বল এসে বুকে লাগল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বুকে কালসিটে পড়ল। মা এসে তার কোচকে বলল, ‘ওর বয়সী ছেলেদের সঙ্গে খেলান আমার ছোট ছেলেটাকে।’ কোচ বুঝলেন মায়ের কথা। কিন্তু বেঁকে বসল ছেলেটাই। বলল, ‘প্লিজ স্যার আমাকে বড়দের সঙ্গে খেলতে দিন। আমার সমবয়সিরা তো আমাকে আউটই করতে পারে না। ওদের সঙ্গে খেলে কী হবে?’’
বিরাট কোহলি এখন ব্যাট করতে নামলে আউট হতে চান না। দেশের মানুষের প্রত্যাশার পাহাড়সমান চাপ নিয়ে রোজ ঘুম থেকে ওঠেন। ব্যাট করতে যান। কোহলি জানেন, নিজের দিনে কেউই তাঁকে আউট করতে পারবে না।
বাবার ছিল ব্যবসা। খুব চাপ ছিল। ব্যবসায়ীরা তো চাপ নিয়েই এগিয়ে চলেন। অত্যধিক চাপে, স্ট্রেসে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ছোট ছোট স্ট্রোক হত মস্তিষ্কে। বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাবার। ছেলেটা তখন মাটির সঙ্গে কথা বলে। রঞ্জি ট্রফির খেলা দিল্লি-কর্ণাটকের মধ্যে। দিনের শেষে ৪০ রানে ব্যাট করছিল ছেলেটা।
পরের দিন আবার ব্যাট করতে নামতে হবে সকালে। কিন্তু রাত তিনটের সময়ে ছেলেটার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড বাবা জীবনযুদ্ধে হেরে গেলেন। ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বও থেমে গেল। প্রতিবেশী এক ডাক্তার কাকুকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু রাত গভীর হওয়ায় কেউ এগিয়ে আসেনি। অ্যাম্বুল্যান্সে খবর দেওয়া হয়েছিল। যখন এল, তখন ছেলেটার বাবার দেহে আর প্রাণ নেই।
পরের দিন খেলতে নামল ছেলেটা। আউট হয়ে গেল। কোচ বলছিলেন, ‘আমি তো তোর বাবা রে। আমি তো রইলাম তোর সঙ্গে।’ ছেলেটা কেঁদেই চলেছে। কোচ ভাবলেন বাবাকে হারানোর শোকে বুঝি কাঁদছে ছাত্র। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতে কাদতে ছেলেটা বলল, ‘স্যার আমি আউট ছিলাম না। আম্পায়ার আমাকে ভুল আউট দিয়েছেন। বল আগে আমার ব্যাটে লেগেছিল। পরে প্যাডে।’
কোচ তো সব শুনে অবাক হয়ে গেল। যার পিতৃশোকে কাঁদা উচিত সে কিনা কাঁদছে ভুল আউট দেওয়ায়।
বিরাট কোহলিকে কেউ কি কাঁদতে দেখেছেন? এই তো সেদিন গোটা বিশ্ব দেখল একার হাতে পাকিস্তানকে হারানোর পরে কাঁদছেন কোহলি। মেলবোর্নে সাররিয়ালিস্ট ছবি। আকাশের দিকে তর্জনী তুলে চোখ বন্ধ করে কী যেন বলছেন কোহলি। হয়তো দূর আকাশে বাবাকে খুঁজছেন। বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। কোহলি এখনও মনে করেন, বাবা রয়ে গিয়েছেন তাঁর সঙ্গেই।
যারা ব্যর্থ হয়েও বারবার ফিরে আসে, তারাই তো চ্যাম্পিয়ন। অনভ্যস্ত জায়গা, ঊষর জমিতেও যাঁরা ফুল ফোটান, তাঁরাই সত্যিকারের তারকা। এক কোচ একবার বললেন, ‘তোমাকে ওপেন করতে হবে।’
ছেলেটা শুনে অবাক! ওপেন? কখনও তো ওপেন করেনি সে। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে হলে তো ওপেনই করতে হবে। সেই ম্যাচে জাতীয় দলের নির্বাচক আসার কথা। ভাল খেলতে পারলে সিনিয়র দলে খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে। ম্যাচের প্রথম দিন থেকে নির্বাচক মাঠে ছিলেন না। যেদিন এলেন তার ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে ছেলেটা ওপেন করতে নামল। সেঞ্চুরি হাঁকাল। নির্বাচক বললেন, ‘এই ছেলেটা দেশের হয়ে খেলবে।’
বিরাট কোহলি এখন ভাবেন, প্রথম দিন যদি তিনি ব্যাট করতে নামতেন, তাহলে তো নির্বাচক তাঁর খেলাই দেখতে পেতেন না। জাতীয় দলেও হয়তো সুযোগ হত না।
কী বলবেন একে? ভাগ্য? টাইমিং? আমরা বলি, ঈশ্বর বিরাট কোহলির জন্য চিত্রনাট্য লেখেন। তাই তো তিনি ফিরে আসেন বারবার।
মালয়েশিয়ায় ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতল। দিল্লীর ওই ছেলেটা ক্যাপ্টেন। আকাশে ওড়ার পালা। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ২০ লাখ টাকায় কিনে নিল তাঁকে। আইপিএলের প্রথম সংস্করণ। সেই সময়ে ২০ লাখ টাকা অনেক। ছেলেটা অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেল। সে তখন উড়ছে। হাতে টাকা, বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক, সামনে স্বপ্নের সব তারকারা। খেলার শেষে পার্টি হত। যৌবনের তেজ তখন। পার্টি, পার্টি আর পার্টিতে মেতে উঠল বাবা হারানো ছেলেটা। ওর কোচ বলতেন, ‘বড্ড বেশি পার্টি করছ তুমি।’
ছেলেটা গুরুকে এড়িয়ে যেত।
পর পর আইপিএলে ব্যর্থ হচ্ছিল সে। সবাই বলছিল বখে যাওয়া, উচ্ছৃঙ্খল ছেলে। একদিন বাড়িতে স্নান করার সময়ে আয়নায় চোখ পড়ল। অন্তরাত্মা বলে উঠল, ‘এরকম বেঢপ চেহারা নিয়ে তুমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে।’
চোখ খুলে গেল ওর। ভিতরে ঝড় উঠল। নিজেকে নিজেই বলে উঠল, ‘আর এভাবে নয়।’ পরের দিন থেকে শুরু হল কঠিন সাধনা। ছেলেটার ফিটনেস এখন মনে করিয়ে দেয় সেই পুরনো বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন–পড়শির ঈর্ষা, গৃহস্থের গর্ব। ওই কঠিন অনুশীলনের ফলে ৬-৮ কেজি ওজন ঝরেছিল। বিরাট কোহলি বলতেন, ‘মাঠে মনে হত আমি উড়ছি। নিজেকে অনেক হাল্কা লাগত।’
২০১১ সালে ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। চার বছর পরে এই ছেলেটার ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে ছিল দেশ। জেতালে এই ছেলেটাই পারবে। এমন বিশ্বাস জন্মেছিল দেশবাসীর। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে স্বপ্নভঙ্গ হয় ভারতের। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ভারত। ছেলেটার ব্যাট বোবা থেকে গেল। গ্যালারিতে সেদিন ছিল ওর প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মা। দেশ হেরে যাওয়ায় সমর্থকদের রাগ গিয়ে পড়ল ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রীর উপরে। সবাই বলে উঠল, ”তুমি অপয়া। তোমার জন্যই বিরাট রান পায়নি। দেশ হেরেছে তুমি ছিলে বলে।’
ছেলেটা ভাবল এ কেমন বিচার! যাঁর সঙ্গে খেলার কোনও সম্পর্কই নেই, তাঁকে কিনা আগুনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে! কলকাতায় এক সাংবাদিক বৈঠকে বিস্ফোরণ ঘটাল ছেলেটা।
কোহলির স্ত্রী পাকিস্তানকে হারানোর পরে আনন্দে খুব নেচেছিলেন। ওঁর ছোট্ট মেয়েটা বুঝতেও পারল না, ওর বাবা কী করেছে। ভাবছি, সেদিন যদি ভারত হেরে যেত। তাহলে কি বিরাট কোহলিকে কাঠগড়ায় তোলা হত? ওর মেয়েকে বড় হয়েও শুনতে হত, ‘তোর বাবা ছিল তবুও পাকিস্তানের কাছে হেরে গিয়েছিল ভারত।’ কী জানি, সন্দেহ লাগে।
ওর নেতৃত্বে ভারত মেঘের উপর দিয়ে হাঁটছিল। যাতে হাত দিচ্ছে তাতেই সোনা ফলছিল। বিশ্বকাপ না জিতলেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজে মারাত্মক সাফল্য। সহ্য হল না অনেকের। ব্যর্থ, তুমি ব্যর্থ। তোমার ব্যাটে রান নেই..সেঞ্চুরি নেই..তুমি বিরাট কোহলি, তোমার কাছ থেকে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর চাই না। একশো, পারলে দুশো কর..তারও বেশি হলে আরও ভাল। ভুলে গেলাম সবাই, ওই ছেলেটাও রক্তমাংসের মানুষ। পাহাড়সমান চাপ সহ্য করা কি মানুষের কাজ! প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। নাকি ওর কেরিয়ার শেষ করে দেওয়ার জন্য খাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল?
ছেলেটা কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া। চাপ অনুভব করত বলে মনে হয় না। কোথায় যেন একবার বলেছিল, ‘কখনও কখনও আমি বোলারকে দেখতে পাই না। দেখতে পাই না প্রতিপক্ষকেও। গ্যালারির শব্দব্রহ্ম আমার কানে ঢোকে না। আমি ব্যাট করার সময়ে দেখি কেবল বল। বলের গতিপথ। তার পরে কাজ করে শুধু ইন্সটিঙ্কট।’
মেসিও তো এরকমই বলেন। আগেভাগে কিছু স্থির করে রাখেন না। বল পায়ে পড়লে ইন্সটিঙ্কট টেনে নিয়ে যায় মেসিকে। পাকিস্তানের ওই ভয়ঙ্কর বোলার হ্যারিস রাউফকে দুটো অস্বাভাবিক ছক্কা মারল সেদিন। রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, ‘কামেথ দ্য আওয়ার, কামেথ দ্য ম্যান। কীভাবে ওরকম দুটো ছক্কা মারলে বিরাট?’ উত্তরে কোহলি বলছে, ‘ইন্সটিঙ্কটলি ব্যাট চালিয়েছি। বল দেখলাম গ্যালারিতে। কীভাবে হল, কী করে করলাম, বলতে পারব না।’, তিনি বাক্যিহারা।
নেতৃত্ব গিয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচার করা হয়েছে ছেলেটার সঙ্গে বনে না সতীর্থদের। ওর সঙ্গে এর সমস্যা, ওর সমস্যা। ভয়ঙ্কর ইগো, খুব অ্যাটিটিউড। রবিবারের পর সব বদলে গিয়েছে। একদিন যারা তাঁকে রক্তাক্ত করেছিলেন, তারা সবাই এখন চুপ। পারফরমাররা তো এভাবেই চুপ করিয়ে দেন সমালোচকদের। যাঁদের সঙ্গে ওঁর ব্যক্তিত্বের সংঘাত রয়েছে বলে রটানো হল, তাঁরাই এসে ওঁকে কোলে তুলে নিলেন। ওঁদের সবার চোখে জল। আনন্দাশ্রু নাকি ভুল বুঝতে পারার জল?
গোটা দেশ কাঁদছে। বিরাট কোহলির আবেগ, দু:খ, অপমান ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদেরও! বুক চেপে ভারতবর্ষ বলছে, ‘বিরাট কোহলিকে কাঁদিও না ঈশ্বর। ওর কান্না যে আমরা সইতে পারব না।’
আমি ধর্ম, আমি অধর্ম, আমি ব্রাহ্মণ, আমি মেথর,
আমি রাস্তা ঝাঁট দিই, আমি ইটভাটায় ইট তুলি
আমি কলেজে পড়ি, আমি জেলখানায়
আমি মাঠে, আমি বস্তিতে, আমি বারোতলায় …
আমাকে চিনলে না?
আমি ভারতবর্ষ।
ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। সেই সূর্য বিরাট কোহলি।