‘ইন্টেন্ট’ প্রচেষ্টার ‘ইম্প্যাক্ট’ ফলাফল

একটা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে ‘ইন্টেন্ট এবং ইম্প্যাক্ট’ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা যাক। মাঠ, কন্ডিশন, প্রতিপক্ষ, সবকিছু বাদ দিয়ে সাদা চোখে দুইজন টপ অর্ডার ব্যাটারের পরিসংখ্যান ধারণা করি। ধারণা করা যাক, আন্তর্জাতিক টি২০ তে একজন ব্যাটারের গড় ৫০ এবং স্ট্রাইক রেট ১৩০। অপরদিকে, অন্য একজন ব্যাটারের গড় ৩০ এবং স্ট্রাইক রেট ১৩০।

আমার বিতর্কিত বক্তব্যটি হচ্ছে, দ্বিতীয় ব্যাটার প্রথম ব্যাটারের থেকে দলের জন্য বেশি ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখেন এবং দল জেতানোর ক্ষেত্রে তার ‘ইন্টেন্ট’ বেশি দেখা যায়। কেন বলছি, সেই ব্যাখ্যাটা পরে বলছি। বরং বোলিংয়ের দিকে কিছুটা নজর দেয়া যাক।

সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া যাক। ক’জন ব্যাটার জাসপ্রিত বুমরাহকে স্কুপ করার চেষ্টা করেন? কিংবা তাকে আক্রমন করে রান বের করার চেষ্টা করেন? ক’জন ব্যাটার রশিদ খানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দেবার সাহস করেন? বুমরাহ – রশিদ খানরা কি বাজে বল করেন না? নিশ্চয়ই করেন। খেয়াল করলে দেখবেন, অনেক সময়ই বুমরাহর একটা ইয়র্কারের বদলে ফুলটস হয়ে যাওয়া বল কিংবা রশিদ খানের একটা খাটো লেন্থের বলও ব্যাটাররা একটা সিঙ্গেলের জন্য খেলছেন।

একটা বাজে বল করার পরেও কেন বেধরক মার খাওয়ার হাত থেকে রেহাই পান? কারণ, একজন ব্যাটার জানেন, বুমরাহর ছোড়া একটা ইয়র্কার কিংবা অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পরে ভেতরে ঢোকা একটা বল তার ইনিংসটা শেষ করে দিতে পারে। গতির ওপরে গুড লেন্থে পড়া রশিদ খানের একটা গুগলি বা ফ্লিপার তার ইনিংসটি শেষ করে দিতে পারে।

এর থেকেও ব্যাটাররা যা বেশি জানে তা হলো, উল্লেখিত কাজগুলো বুমরাহ বা রাশিদ নিয়মিতই করতে পারেন। এই বোলারদের মোকাবেলার ক্ষেত্রে ব্যাটাররা রক্ষনাত্মক ভূমিকা গ্রহন করেন। ব্যাটারদের মধ্যে যে রক্ষনের ভয়টি ধরিয়ে দেয়া গেলো, তার নামই ‘ইম্প্যাক্ট’, যা এই দুই বোলার তৈরি করেছেন। ‘ইম্প্যাক্ট’ নামক এই ভয় একদিনে তৈরি হয় নি। বছরের পরে বছর ধরে বুমরাহ-রাশিদ নিয়মিত পারফর্ম করে ব্যাটারের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করতে বাধ্য করেছেন। বছরের পরে বছর ধরে ব্যাটারকে আক্রমণ করা, পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার যেই প্রচেষ্টা, তার নাম ‘ইন্টেন্ট’।

আক্ষরিক অর্থে, আপনি যা কিছু করতে চাচ্ছেন, তাই আপনার ‘ইন্টেন্ট’ এবং সেই কাজের ফল যে আসছে, তাই আপনার ‘ইম্প্যাক্ট’। তবে, বর্তমানের আলোচিত ‘ইন্টেন্ট’ এবং ‘ইম্প্যাক্ট’ আসলে ‘গুড ইন্টেন্ট’ এবং ‘গুড ইম্প্যাক্ট’। এখানে আপনার গা বাচানো বোলিংয়ের সুযোগ নেই। যখন ১৩০-১৪০ রান ডিফেন্ড করছেন, তখন আপনাকে উইকেট নেয়াকে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে।

আবার, যখন ২০০ রান ডিফেন্ড করছেন, উইকেট নেয়া এবং রান না দেয়াকে আপনার সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কোনক্ষেত্রেই, আপনি একের পরে এক ‘কাটার’ কিংবা লেগ স্ট্যাম্পের উপর গুড লেন্থে বল ঠুকে যেতে পারবেন না। আপনাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটারের উপরে আক্রমণে যেতে হবে। অপরদিকে, একজন ব্যাটার ১৩০ রান চেজ করার সময় ৫০ বলে ৫০ করতে পারেন কিন্তু ২২০ চেজ করার সময় ৩৫-৪০ বলে ৫০ করতে পারেন না। অর্থাৎ দলের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিস্থিতি বুঝে পারফর্ম করার প্রচেষ্টার নাম ‘ইন্টেন্ট’ এবং তার ফলাফলের নাম ‘ইম্প্যাক্ট’। ‘ইন্টেন্ট এবং ইম্প্যাক্ট’ এর সহজ পাঠ এতটুকুই।

একই দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় যখন নিয়মিত ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখতে শুরু করেন, প্রতিপক্ষ সেই দলকে ভয় পেতে শুরু করে। নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সদ্য সমাপ্ত ট্রাই নেশন সিরিজে শান মাসুদের ব্যাটিং খেয়াল করলে দেখবেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংস ব্যাটিং করলেও স্ট্রাইক রেট ১০০ এর নিচে।

অপরদিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র ইনিংসে রান করেছেন ২১ বলে ৩২। স্ট্রাইক রেটের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তার ব্যাটিংয়ের ধরন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেখানে তিনি খোলস বন্দি ছিলেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে সেখানে প্রথম বল থেকেই আক্রমণ করেছেন। এমন নয় যে টিকেনার কিংবা ব্রেসওয়েল আমাদের তাসকিন-মিরাজের থেকে বেশি ভালো বল করেছেন। বরং নিউজিল্যান্ডের বোলার হিসেবে ভালো করতে পারেন ভাবনাই শান মাসুদকে খোলস বন্দি করে রেখেছিলো।

নিউজিল্যান্ডের দলগত ‘ইম্প্যাক্ট’ এখানেই এবং একারনেই যখন প্রতিপক্ষের নাম হয় অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা ইন্ডিয়া, আমরা তাদের ‘ইম্প্যাক্ট’ এর ভয় পাই। আমাদের কয়েকজন খেলোয়াড়ও যদি বছরের পরে বছর ধরে ‘ইম্প্যাক্ট’ তৈরি করতে পারেন, বাংলাদেশ নামটিও প্রতিপক্ষের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করবে। অন্যথায় নির্দিষ্ট একজন বা দুইজন ‘ইম্প্যাক্ট’ খেলোয়াড়ই যতটুকু সমীহ আদায় করে নিবেন। দলগতভাবে ‘ইম্প্যাক্ট’ খুব বেশি দেখা যাবে না।

আলোচনার এই পর্যায়ে প্রথম বক্তব্যটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক। ব্যাখ্যার জন্য আমার সাধারণ ধারণাটিই গ্রহণ করবো। একজন ব্যাটার ইনিংস শুরুর সময়ে কিছুটা সময় নিবেন এবং সেট হওয়ার মাধ্যমে রানের একসেলেরেশন রেট বাড়াতে থাকবেন। এক্ষেত্রে, উল্লেখিত দুইজন ব্যাটারের স্ট্রাইক রেট সমান হলেও গড় রানে প্রথম জন এগিয়ে।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায় প্রথম ব্যাটার সাধারণত লম্বা ইনিংস খেলেন। এবং তার ধারাবাহিকতার কারনেই ইনিংস প্রতি স্ট্রাইক রেট খুব বেশি পরিবর্তিত হচ্ছে না। একটা ইনিংসের সিংহভাগ বল খেলার পরে তার ৫০ বলে ৬৫ রান আধুনিক ক্রিকেটে অধিকাংশ সময়ে দলের উপকার না করে ক্ষতি করবে বেশি। ২০ ওভার শেষে দলের রান ১৮০ থেকে ১৬০ এ নামিয়ে আনতে এই ইনিংসের ভূমিকাই বেশি থাকবে। অপরদিকে দ্বিতীয় ব্যাটার আশ্চর্য ধারাবাহিক না হওয়ার কারনে, যেই ইনিংস বড় করতে পারলেন না, সেই ইনিংসে স্ট্রাইক রেট বাড়াতে পারলেন না।

কিন্তু, পরের ইনিংসে যখন তিনি রান বেশি করছেন, একসেলেরেটও করছেন বেশি। অর্থাৎ এই ব্যাটারের থেকে একটা ১০ বলে ৮ রানের ইনিংসে পরে আপনি ৪০ বলে ৬০ রানের ইনিংস দেখতে পাবেন। দ্বিতীয় ব্যাটারের থেকে আপনি প্রতি দুই ইনিংসে একটা ‘ইম্প্যাক্ট’ ইনিংস দেখার সুযোগ পাচ্ছেন এবং যেই ইনিংসে তিনি ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখতে পারছেন না, সেই ইনিংসেও তিনি খুব বেশি বল নষ্ট করতে পারেন নি, যেন ভিন্ন একজন ব্যাটারকে চাপে ফেলে দেয়। এই কারনেই ৪২ গড় এবং ১৪০ স্ট্রাইক রেটের ডেভিড মালানের থেকে ৩৩ গড় এবং ১৪৩ স্ট্রাইক রেটের জস বাটলার টি২০ তে বেশি ইম্প্যাক্টফুল খেলোয়াড়। এই কারনেই প্রথমে উল্লেখিত দুই ব্যাটারের দ্বিতীয় ব্যাটার দলের প্রয়োজনে বেশি ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখতে পারেন।

আলোচনা শেষ করতে চাই। কেবলমাত্র এতটুকু জানিয়ে রাখি, পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে রাব্বির ২০ বলে ৪২ রানের ইনিংসের খুব বেশি ‘ইম্প্যাক্ট’ নেই। এই রান নেট রান রেটের উন্নতি বাদে দলের কোন উপকারে আসে নি। কিন্তু এই একই ইনিংস যদি দুই উইকেট আগের কোন ব্যাটার খেলতেন, সেটি ‘ইম্প্যাক্ট’ ইনিংস হতো। সেক্ষেত্রে রিকোয়ার্ড রান রেট আমাদের নাগালের বাইরে না যাওয়ার সুযোগ থাকতো।

রাব্বি কিংবা সোহানের মধ্যে ‘ইম্প্যাক্ট’ তৈরি করতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে, বাকিটা তাদের যোগ্যতার ব্যাপার, প্রতিনিয়ত উন্নতির ব্যাপার, ‘ইন্টেন্ট’ এর ব্যাপার। যদি তারা ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে অন্য কেউ যিনি ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখতে পারেন, তাকে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ১০০ টি-টোয়েন্টি খেলা একজন ১৫ গড় এবং ১১৫ স্ট্রাইক রেটের ব্যাটারের ‘রিপ্লেসমেন্ট’ খোজার কিছু নেই, তার ‘অল্টারনেটিভ’ খুঁজতে হয়। তাঁর ‘ইন্টেন্ট’ ছিল না এবং তিনি ‘ইম্প্যাক্ট’ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link