ধুঁকতে থাকা একটি দল। কিন্তু পিঠ দেয়ালে ঠেকতেই যেন মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল। টানা দুই হারের পর কোনোমতে লজ্জা বাঁচিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করার দিকে একমাত্র লক্ষ্য যখন, ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়ালো দলটা। কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা নিয়ে অলৌকিকভাবে সেমিতে ওঠা গেল শেষ পর্যন্ত। তবে এবার আর ভাগ্যের সহায়তা নয়।
গ্রুপ ‘এ’-র চ্যাম্পিয়ন দলকে কোনোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারই সুযোগ দিল না তারা। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম ফাইনালিস্ট হিসেবে মেলবোর্নের মহারণে নিজেদের টিকিট নিশ্চিত করলো, আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান।
ক্রিকেটে ‘ক্লিনিক্যাল পারফরম্যান্স’ বলতে একটা টার্ম আছে। সেটা হয়তো স্বীকৃত কিছু নয়, কিন্তু ক্রিকেটে সমর্থক থেকে শুরু করে বিশ্লেষকদের মুখে বহুল পরিচিত এই শব্দটা। সিডনির মাটিতে এবারের প্রথম সেমিফাইনালে পাকিস্তানের পারফরম্যান্সকে এমন শব্দের বিশেষণে বিশেষায়িত করাই যায়। কারণ বোলিং থেকে ব্যাটিং, ফিল্ডিং- সব খানেই ছিল দারুণ বিচরণ। সেটা কতটা দুর্দান্ত ছিল তার কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক করলেই বুঝা যায়।
ফিন অ্যালেন, কিউই এ ব্যাটারকে এরই মধ্যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ভবিষ্যত তারকা ভাবা হচ্ছে। হবেই বা না কেন? অভিষেকের পর ন্যুনতম ২০ ইনিংস খেলেছেন, এদের মধ্য সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট তার(১৬৫.৬৮)।
এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডের হয়ে যে ম্যাচেই ৩০ রানের উপরে ইনিংস খেলেছেন সে ম্যাচেই কিউইরা জয়ের মুখ দেখেছে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর ব্যাটেই নিউজিল্যান্ড বড় সংগ্রহের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। সব কিছু মিলিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে বড় একটা হুমকির নাম ছিল এই ফিন অ্যালেন।
তবে পাকিস্তানের জন্যও একটা টোটকা ছিল। ফিন অ্যালেনের এ বিশ্বকাপে উইকেটে থাকার স্থায়িত্ব ছিল গড়ে ৮.৭৩ টি করে বল। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়েই তিনি বাঁ-হাতি পেসারের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানের জন্যও তাই ভরসার নাম ছিল শাহিন শাহ আফ্রিদি। ফিন অ্যালেনের কাছে প্রথম বলেই হজম করলেন ৪ রান। কিন্তু পরে বলেই এলবিডব্লিউ’র আবেদন। আম্পায়ারও তর্জনী তুলে জানিয়ে দিলেন, অ্যালেন আউট। কিন্তু রিভিউ নিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
তবে শাহিন আফ্রিদি তো থামবার পাত্র নয়। পরের বলটিতেই ছুঁড়লেন ভয়ংকর আরেকটি ইয়র্কার। আর সে বলেও পরাস্ত হলেন ফিন অ্যালেন। আম্পায়ার এবারও এলবিডব্লিউ’র আবেদনে সাড়া দিলেন। একই ভাবে, ফিন অ্যালেনও নিলেন রিভিউ। কিন্তু এবার আর কাজে আসলো না।
ফিন অ্যালেনকে শেষ পর্যন্ত প্যাভিলিয়নের পথেই হাঁটা লাগল। এভাবেই মাত্র ৩ বলেই শেষ হয়ে যায়, শাহিন-ফিন অ্যালেন যুদ্ধ। তাতে প্রথম বলে ফিন অ্যালেন আগ্রাসন দেখালেও পরে দুই বলে শাহিন আফ্রিদির কাছে তিনি রীতিমত ধরাশায়ী।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একটি ক্যাচ, একটি দারুণ ফিল্ডিংয়ে রান আউট, অনেক সময় ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়- এমন চিরন্তন বাণী বলতে গেলে প্রায় প্রতিষ্ঠিত। পাকিস্তানের শাদাব খানও সেটি করলেন। ফিন অ্যালেনকে ফেরানোর পর আরেক ওপেনার কনওয়েকেও পাকিস্তানের আউট করার প্রয়োজন ছিল।
কারণ উইকেটে টিকে গেলে কনওয়ে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সে ব্যাপারটা সবারই জানা। শাদাব খানের করা দুর্দান্ত রান আউটে কনওয়ে আর উইকেটে টিকে থাকতে পারলেন না। দৌড়ে একটি সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় শাদাব খানের দারুণ একটি থ্রো। আর সেখানেই কনওয়ের ২০ বলে ২১ রানের ইনিংসটির সমাপ্তি ঘটে।
নিউজিল্যান্ড এরপর থেকে উইকেট বাঁচিয়ে রেখে খেলে গিয়েছে। কিন্তু রানের গতিটা আর ঠিকঠাক করতে পারেনি। তাতে অবশ্য পাকিস্তানের ডেথ ওভারের বোলারদের কৃতিত্বই বেশি। নিউজিল্যান্ডের ড্যারিল মিচেল যদিও ফিফটি তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু কিউইদের ইনিংস সর্বসাকুল্যে ১৫২ তেই থেমে যায়।
১৫৩ রানের লক্ষ্য। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেটাকে গড়পড়তা টার্গেটের বেশি কিছু বলা যায় না। কিন্তু পাকিস্তানের দুই ওপেনারও যে পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে রয়েছে অফফর্মে। তাই এমন টার্গেটেও সম্ভাবনার পাশাপাশি শঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু বাবর-রিজওয়ান ফিরলেন একদম মোক্ষম সময়ে। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে টা ব্যবহার করলেন একদম যথাযথভাবে।
যেমন লক্ষ্য, ঠিক তেমন ব্যাটিং। ক্যালকুলেটিভ ব্যাটিং যেটাকে বলে। আর এভাবেই পঞ্চাশ পেরিয়ে শতরানের জুটি গড়লো এ দুই ব্যাটার। পাকিস্তানের ম্যাচ জয়ের রাস্তাটা সেখানেই খুলে গিয়েছে। এরপরে পাকিস্তান লক্ষ্যে পৌঁছে যায় সহজেই। শেষের উইনিং শটটা খেললেন শান মাসুদ। আর তার আগের শেষ ঝলকটা দেখান ২১ বছর বয়সী তরুণ ব্যাটার মোহাম্মদ হারিস।
ক্যালকুলেটিভ জুটি আর মোহাম্মদ হারিসকে নিয়ে অধিনায়ক বাবর নিজেও ম্যাচ শেষে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার আর রিজওয়ানের লক্ষ্যই ছিল পাওয়ার প্লে ঠিক ঠাকভাবে ব্যবহার করে নিউজিল্যান্ডকে ব্যাকফুটে ফেলে দেওয়া। আমরা সেই পরিকল্পনায় সফল হয়েছি। আপনি যখন চেজ করবেন, তখন আপনাকে ঝুঁকি নিতে হবেই। আমি যখন আউট হয়েছি, তখন মোহাম্মদ হারিস উইকেটে এসেই দারুণ ব্যাটিং করেছে। সে যেভাবে খেলেছে, তাতে মনেই হচ্ছে না, এটা তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ।’
আগামী ১৩ অক্টোবর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফাইনালে ভারত অথবা ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে পাকিস্তান। শেষবার ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান। এরপরে আর কখনোই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা হয়নি পাকিস্তানের। ১৩ বছর পরে আবারও সেই শিরোপা জয়ের হাতছানি।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার-১২ এর সবগুলো ম্যাচ জিতলেও সেমিতে এসে হেরে গিয়েছিল বাবর আজমের দল। এবার শুরুটা হয়েছিল বাজে, কিন্তু সুন্দর শেষের একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। বাবর আজমরাও শেষটা নিশ্চিতভাবেই রাঙাতে চাইবে। কারণ কথায় আছে , শেষ ভাল যার সব ভাল তাঁর।