জাগ্রত জার্মান মেশিন

বিশ্বকাপের সবচেয়ে ধারাবাহিক দলটার নাম জার্মানি। চারবার বিশ্বজয়ের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল খেলা দল। অথচ সেই দলটাই কিনা রাশিয়া বিশ্বকাপে পেরোতে পারেনি গ্রুপ পর্বের বাঁধা। রাশিয়ার সেই দুঃস্মৃতি ভুলতেই কিনা তারুণ্যনির্ভর এক জার্মান দল নিয়ে বিশ্বকাপে আসছেন হ্যান্সি ফ্লিক। 

চার বছরে বদলে গিয়েছে জার্মান দলটার খোলনালচ। এক যুগের বেশি সময় কোচের দায়িত্ব পালনের পরে সরে গিয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ী জোয়াকিম ল্যো। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে সেই আসনে বসেছেন নিজের প্রথম মৌসুমেই বায়ার্ন মিউনিখকে ট্রেবল জেতানো হ্যান্সি ফ্লিক। দায়িত্ব পেয়েই বদলে ফেলেছেন দলটাকে, দারুণ প্রতিভাবান সব ফুটবলারদের সুযোগ করে দিয়েছেন। দলটাও ফিরেছে সেই পুরনো ছন্দে, এবারের বিশ্বকাপ তাই জার্মানদের জন্য পুরোনো ক্ষতে প্রলেপ দেবারও। 

মাঝে জোয়াকিম ল্যো তিন সেন্টারব্যাক নিয়ে দল সাজালেও ফ্লিক দায়িত্ব পাবার পরই ফিরে গিয়েছেন পুরনো ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। গোলবারের নিচে পুরনো মুখ ম্যানুয়েল নয়্যার। বয়সটা যতই বাড়ছে ততোই যেন পুরনো ওয়াইনের মত সুস্বাদু হচ্ছেন এই গোলরক্ষক। অবিশ্বাস্য সব সেভ তো বটেই গোলকিক থেকে দারুণ সব পাস বাড়াতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্বের দায়ভারও থাকবে তাঁর কাঁধেই।

নয়্যার ইনজুরিতে পড়লেও খুব একটা ভাবতে হবে না ফ্লিককে, কারণ বেঞ্চে আছেন মার্ক আন্দ্রে টার স্টেগেন। গত মৌসুমটা বাজে কাটালেও এই মৌসুমে পুরনো ছন্দে ফিরে এসেছেন বার্সেলোনার এই কিপার। 

গোলরক্ষকের সামনে দুই সেন্টারব্যাকের পজিশনে বায়ার্নের দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার নিকোলাস সুলের জায়গাটা প্রায় নিশ্চিত। তাঁর সঙ্গী হওয়ার জন্য লড়বেন রিয়াল মাদ্রিদের আন্তোনিও রুডিগার এবং বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের নিকো শ্লোটারব্যাক। সাম্প্রতিক ফর্ম অনুসারে রুডিগার এগিয়ে থাকলেও শ্লোটারব্যাকে বড় প্লাসপয়েন্ট তিনি বাঁ পায়ের ফুটবলার। বিশ্ব ফুটবলে বাঁ পায়ে স্বাছন্দ্য সেন্টারব্যাকদের চাহিদার কথা কে না জানে। 

ফিলিপ লামের পর রাইটব্যাক পজিশনে জশুয়া কিমিখকে পেলেও তিনি মিডফিল্ডার বনে যাওয়ার পর বিশ্বমানের আর কাউকে পায়নি জার্মানি। থিলো কেহরার এবং লুকাস ক্লস্টারম্যান দুজনেই মধ্যম মানের ডিফেন্ডার। নিজেদের দিনে হয়ত ভাল পারফরম্যান্স দেবেন, কিন্তু নকআউট পর্বে বিশ্বমানের উইংগারদের কতোটা সামলাতে পারবেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে এক্ষেত্রে নিকোলাস সুলেকে রাইটব্যাকে খেলিয়ে একটা বাজি ধরতে পারেন ফ্লিক।

দীর্ঘদেহী এই ডিফেন্ডার ক্লাবে প্রায়ই রাইটব্যাকে খেলে থাকেন। সেক্ষেত্রে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে জুটি বাঁধবেন রুডিগার এবং শ্লোটারব্যাক। জার্মানির বাঁ প্রান্ত সামলানোর দায়িত্বটা এবার থাকবে ডেভিড রমের উপর। আশ্চর্যজনকভাবে এই পজিশনে কোনো ব্যাকআপ ফুটবলার রাখেননি কোচ ফ্লিক। 

রক্ষণভাগে খানিকটা দুশ্চিন্তার জায়গা থাকলেও জার্মানির মাঝমাঠ বিশ্বের সেরা। বিশ্বকাপ জয়ী টনি ক্রুস-স্যামি খেদিরা জুটির উত্তরসূরি হিসেবে এবার জুটি বাঁধবেন জশুয়া কিমিখ এবং এলকায় গুন্ডোগান। নিজ নিজ ক্লাবে দুজনেই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। পেপ গার্দিওলার অধীনে রাইটব্যাক থেকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বনে যাওয়া কিমিখকে দলে পাওয়া বিশ্বের যেকোনো কোচের জন্যই স্বপ্ন।

প্রতিপক্ষের আক্রমণ থামিয়ে দেয়ার পাশাপাশি আক্রমণে সহায়তা করা – দুই ভূমিকাতেই দারুণ সফল তিনি। লাইন ব্রেকিং সব পাস খেলে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ উন্মুক্ত করে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মাঝমাঠে তাঁর সাথে জুটি বাঁধবেন ম্যানচেস্টার সিটির ইলকায় গুন্ডোগান।

বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার হলেও গোলের রাস্তাটা ভালই চেনেন তিনি, গত মৌসুমের শেষ ম্যাচে জোড়া গোল করে ম্যানসিটিকে শিরোপা জিতিয়েছেন তিনিই। বেঞ্চে বসবেন বায়ার্নের লিওন গোরেৎজা, ইনজুরি সমস্যা ছাপিয়ে জার্মানির মিডফিল্ডে তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। 

জার্মানির আক্রমণভাগে এবার তরুণ ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। এক টমাস মুলার বাদে সবার বয়সই পঁচিশের নিচে। তবে গোলের জন্য জার্মানি তাঁকিয়ে থাকবে বায়ার্নের তিন তারকার উপর – জামাল মুসিয়ালা, লেরয় সানে এবং সার্জে গ্যানাব্রি। বিশেষ করে ১৮ বছর বয়সী মুসিয়ালাকে ভাবা হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ। গোল করা কিংবা করানো দুই ভূমিকাতেই দারুণ সফল সদ্য কৈশোর পেরোনো এই তরুণ। এই মৌসুমে ২১ ম্যাচ খেলে ১২ গোলের পাশাপাশি করিয়েছেন ৮ গোল। তাঁর পাশাপাশি দুই উইংয়ে গতির ঝড় তুলবেন সানে এবং গ্যানাব্রি। 

তবে সবচেয়ে বড় চমক বোধহয় ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করা মারিও গোৎজের ফিরে আসা। এক সময় তাঁকে ভাবা হত মেসির উত্তরসূরী, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গিয়েছিলেন বিস্মৃতির আড়ালে। তবে আট বছর বাদে আবারও বিশ্বকাপ দলে ফিরে এসে জানিয়ে দিলেন এখনও ফুরিয়ে যাননি তিনি।

এছাড়া দলে আরও রয়েছেন কাই হ্যাভার্টজ, ইউসুফ মৌকৌকো, করিম আদেয়েমি, জোনাস হফম্যান, জুলিয়ান ব্রান্ডটের মত প্রতিভাবান তরুণরা। তবে ১৬ বছর বয়সী বিস্ময়বালক মৌকৌকোর সুযোগ পাওয়াটা চমক হয়ে এসেছে বাকি বিশ্বের জন্য, এই কিশোরের যে এখনও  জাতীয় দলে অভিষেকই ঘটেনি।  

এবারের জার্মানি দলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে। গত দুই বছর ধরে যিনি নিয়মিত খেলেছেন সেই টিমো ভের্নার ইনজুরির কারণে ছিটকে গিয়েছেন বিশ্বকাপ দল থেকে। কাই হ্যাভার্টজ, জুলিয়ান ব্রান্ডট, করিম আদেয়েমিরা ঠিক প্রথাগত স্ট্রাইকার নন, বরং উইং থেকে কাট করে বক্সে ঢুকতেই বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করেন।

তাছাড়া ক্লাব ফুটবলেও তাঁরা তেমন একটা সুবিধাজনক ফর্মে নেই, হ্যাভার্টজ প্রায়ই সহজ সব সুযোগ মিস করে হাস্যরসের পাত্র হচ্ছেন। আদেয়েমি তো খুব বেশি ম্যাচে মাঠে নামারই সুযোগ পাননি, ইনজুরির কারণে মিস করেছেন মৌসুমের প্রথম ভাগ। 

সব মিলিয়ে এবারের জার্মানি দলের এক্স ফ্যাক্টর তাই কিশোর মৌকৌকো। বিস্ময়বালক উপাধি পাওয়া এই স্ট্রাইকার বিশ্বকাপে আসবেন বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে গোল করার সুখস্মৃতি নিয়ে। বড় ম্যাচগুলোতে যদি নিজের স্নায়চাপ সামলে স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেন তিনি, তবে হ্যান্সি ফ্লিকের দলকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে বাকি দলগুলোর জন্য। 

এবারের বিশ্বকাপে স্পেন, কোস্টারিকা এবং জাপানের সাথে একই গ্রুপে পড়েছে জার্মানি। ফলে তাঁদের জন্য দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়াটা মোটেও সহজ হবে না। তাছাড়া গ্রুপ রানার্স আপ হলে দ্বিতীয় রাউন্ডেই দেখা হয়ে যেত টুর্নামেন্টের আরেক ফেবারিট বেলজিয়ামের সাথে। সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপ হ্যান্সি ফ্লিকের দলের জন্য অগ্নিপরীক্ষাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link