প্রথমে ব্যাটিং করার কুফল

একটু চমকে দেওয়া তথ্য দিয়ে শুরু করা যাক। গেল দশক থেকে এই দশক অবধি মোট চার খানা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিশ্চয়ই এটা চমকপ্রদ কোন তথ্য নয়। তবে এই চার আসরে ১২টি নকআউট পর্বের ম্যাচ অর্থাৎ সেমিফাইনাল ও ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটাও নিশ্চয়ই কোন চটকদার তথ্য নয়। তবে এই ১২ ম্যাচের ১১টি ম্যাচেই যে প্রথমে ব্যাটিং করা দল হেরেছে সেটা নিশ্চয়ই দারুণ চমকপ্রদ একটা তথ্য।

নিশ্চয়ই চেষ্টা করছেন স্মৃতি হাতড়ে তথ্যের সাথে মিল খুঁজে বের করবার। খুব বেশি স্মৃতিতে জোর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০১৪ সালে মিরপুরে শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ম্যাচটিতে শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাট করেছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে ক্যারিবীয়দের ব্যাটিংয়ের সময় আঘাত হানে কাল বৈশাখী ঝড়। সেবার ডাকওয়াথ লুইস পদ্ধতির মারপ্যাঁচে জিতেছিল শ্রীলঙ্কা। এই ১২টি নকআউট ম্যাচের মধ্যে সেবারই প্রথম ব্যাট করা দল জয় পেয়েছিল। নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, এর কারণ কি?

এমনটা হবার কারণের সন্ধান করেছে উইজডেন। সে আলোকেই, আলোচনাটা সেরে নেওয়া যাক। প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্যাটার্নটা একই রকম। এই ১১ ম্যাচের প্রতিটিতে প্রথমে ব্যাট করা দল হাতখুলে ব্যাটিং করবার জন্যে অপেক্ষা করেছে ইনিংসের দ্বিতীয় অংশের জন্যে। প্রথম দশ ওভারে তাঁরা খানিকটা রয়েসয়ে ব্যাটিং করবার চেষ্টা করেছেন। ১১ ম্যাচের মধ্যে নয় ম্যাচেই পাওয়ারপ্লের ছয় ওভারে দলগুলো ৪৭ বা তার কম রান করেছে। এরপর ইনিংসের মধ্যভাগ অবধি পৌঁছাতে তাদের রান পেরুতে পারেনি ৭১ রানের গণ্ডি।

স্রেফ দুই দফা এমনটা হয়েছে। সেটাও আবার হয়েছে ২০১৬ সালের দুই সেমিফাইনালে। নিউজিল্যান্ড ৫১ রান সংগ্রহ করে এক উইকেট হারিয়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দিল্লিতে হওয়া সে ম্যাচে তাঁরা প্রথম দশ ওভার শেষে ৮৯ রান জড়ো করে তাদের সংগ্রহে। উইকেট সেই একটিই ছিল। তবে দিল্লির সেই উইকেটটি ছিল যথেষ্ট ব্যাটিং সহায়ক। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ড পাওয়ারপ্লেতে ৬৭ রান সংগ্রহ করে এবং দশ ওভার শেষে এক উইকেট হারিয়ে ৯৮ রান তোলে স্কোর বোর্ডে। সহজেই সে ম্যাচটি জিতে নিয়েছিল ইংল্যান্ড।

আর ভারত একটা ভাল শুরু পায়। পাওয়ারপ্লেতে ৫৫ রান সংগ্রহের পর তাঁরা কিছুটা স্লো ব্যাটিং করা শুরু করে ও এক উইকেটের বিনিময়ে ৮৬ রানে গিয়ে থামে প্রথম দশ ওভার শেষে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাওয়াপ্লেতে পিছিয়ে ছিল ভারতের থেকে। ৪৪ রানে দুই উইকেট হারায় তাঁরা। পরবর্তীতে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে ৮৬ রান অবধি পৌঁছায়।

এমনও নয় যে দলগুলো শুরুর দিকে একাধিক উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। ১১ ম্যাচের মধ্যে দশবারই প্রথম দশ ওভারের মধ্যে তিনের কম উইকেট হারায় দলগুলো। একবার শুধু ইংল্যান্ড ২০১৬ সালের কলকাতা হওয়া ফাইনাল ম্যাচে তিন উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সুতরাং উইকেট হারানোটাও মূল বিষয় ছিল না। হাতে উইকেট রেখেও প্রথমে ব্যাটিং করা দলগুলো আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি।

এমনটা হবার কারণ অবশ্য মানসিকতা। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দল জানে তাদের লক্ষ্যমাত্রা কত। তাছাড়া কত দ্রুত রান করতে হবে, পিচ কেমন ব্যবহার করছে সে সব কিছুই আয়ত্ব করা থাকে। তাছাড়া ‘বিগম্যাচ’ বলে একটা টার্ম যুক্ত হয়েছে ক্রিকেটের সাথে। যা বাড়তি চাপ ফেলে খেলোয়াড়দের মানসিকতায়। তাছাড়া বড় ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করা ব্যাটাররা একটা বাজে শুরু করতে চান না। তাইতো তাঁরা একটু ধীরগতিতে, বাইশ গজে সেট হবার পর হাত খুলে খেলতে চেষ্টা করেন।

ওয়ানডে ফরম্যাটে সে সময়টুকু হয়ত মেলে। তবে টি-টোয়েন্টির যুগে সে সময় নেই। এমনকি টি-টোয়েন্টিতে যখন ব্যাটাররা এক্সেলারেট করা শুরু করেন, ততক্ষণে ইনিংসের ৩/৪ অংশ শেষ হয়ে যায়। খুব বেশি সুযোগও থাকে না তখন। এমন অবস্থায় যেহেতু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দল লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াও পারিপার্শ্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে নামার সুযোগ পায় তাই তাঁরা এগিয়ে থেকে শেষ অবধি জয়লাভ করতে সক্ষম হয়।

এমনটা যে শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঘটেছে তাও নয়। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রেকর্ড ঘাটলেও প্রথমে ব্যাট করে হেরে যাওয়া দলের সংখ্যা বেশি। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় একটি। নিকট ভবিষ্যতে প্রথমে ব্যাট করা দলকে নিজেদের একটা টার্গেট সেট করে নিতে হবে। শুরু থেকেই খানিকটা আগ্রাসী হয়েই খেলতে হবে। নতুবা দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করাদের জয়রথ চলতেই থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link