কেন জাতীয় সঙ্গীত গায়নি ইরান?

কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিনে খলিফা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং ইরান। জাতীয় সংগীত চলাকালীন সময়ে ইংলিশ ফুটবলাররা  চিৎকার করে তাল মেলাচ্ছিলেন, অন্যদিকে নিজেদের জাতীয় সংগীতের বেলায় চুপচাপ ছিলেন ইরানের ফুটবলাররা। এমনকি গ্যালারিতে থাকা দর্শকেরা পর্যন্ত ব্যু দিয়েছেন জাতীয় সংগীত চলাকালীন সময়ে। কেন এমনটা হল?

ফুটবল মাঠে এমন দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত নন ফুটবলপ্রেমীরা। এমনিতেই কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ধেয়ে আসছে গোটা বিশ্ব থেকে। ইরানও সেই সুযোগটা নিয়েছে, প্রতিবাদের মাধ্যমে নিজেদের দাবিটাকে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। 

ইরানের নারীদের জীবনটা আর দশটা নারীর মত সহজ না। তাঁদেরকে সব সময় মুখ ঢেকে রেখে বাইরে বেরোতে হয়, স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করার সুযোগটাও নেই তাঁদের। এবারের কাতার বিশ্বকাপ দেখতে আসা ইরানি সমর্থকরা তাই নারীদের অধিকার রক্ষার প্রতিবাদ জানাতে স্টেডিয়ামে এসেছিলেন নানা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তাতে লেখা ছিল, ‘নারীদের স্বাধীনতা চাই।’ 

কেবল স্বাধীনতা কিংবা মুক্ত চলাচল নয়, এই আন্দোলন ছিল মাহসা আমিনির জন্যও। গত সেপ্টেম্বরে ২২ বছর বয়সী এই তরুণী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকার সময়েই রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে তাঁর, যার কোনো ব্যাখ্যাই দিতে পারেনি ইরানি পুলিশ। এটা স্পষ্টই যে, পুলিশের অত্যাচার এবং অবহেলাতেই মৃত্যু ঘটে তাঁর।

অথচ বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে হলে গ্রেপ্তারই হতেন না আমিনি, তাঁকে আটক করার কারণ ছিল তিনি নাকি হিজাবটা ঠিকভাবে পড়েননি। তাঁর মৃত্যুর পর একের পর এক মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে গেছে ইরান সরকার, যার কোনোটাই যৌক্তিক নয়। আমিনির মৃত্যুতে যেন টনক নড়ে ইরানের জনগণের, সারা দেশজুড়ে সমালোচনা এবং প্রতিবাদের ঝড় উঠে। দেশের এমন উথাল-পাতাল পরিস্থিতি সঙ্গী করেই কাতারগামী বিমানে চড়েন ফুটবলাররা।

ফুটবল মাঠে এসেও তাই দেশবাসীর সাথে একাত্মা হলেন ফুটবলাররা। এদিন সবার চোখ ছিল ইরানের সবচেয়ে বড় ফুটবল তারকা বায়ার লেভারকুসেনের স্ট্রাইকার সরদার আজমুনের উপর। ইনজুরির কারণে গত সেপ্টেম্বর থেকেই মাঠের বাইরে তিনি।

নারীদের অধিকার আদায়ের এই সংগ্রামে শুরু থেকেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এই তারকা। ফলে বিশ্বকাপ দলেই তাঁর জায়গা পাওয়া নিয়ে টানাটানি পরে গিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কোচ কার্লোস কুইরোজ স্কোয়াডে রাখেন তাঁকে। এদিন অবশ্য মাঠে নামেননি তিনি।

যদিও মাঠের খেলাতে নিজেদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাব বজায় রাখতে পারেনি ইরান। ম্যাচের শুরু থেকেই ইংলিশদের উপর্যুপরি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে ইরানের ডিফেন্স। প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে তাঁরা। দ্বিতীয়ার্ধে এক মুসা তারেমি দুই গোল করে ব্যবধান খানিকটা কমালেও শেষ পর্যন্ত বড় হারই সঙ্গী হয়েছে তাঁদের।

গোটা ম্যাচে তারেমিকে সামান্যতম সঙ্গও দিতে পারেননি কেউই, ফলশ্রুতিতে ৬-২ গোলের হার দিয়েই বিশ্বকাপ শুরু হল তাঁদের। তবে ম্যাচের জয় – পরাজয় ছাপিয়ে ইরানের ফুটবলাররা প্রশংসিত হয়েছেন তাঁদের সাহসী মনোভাবের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা না নোয়াবার জন্য। জান্তা সরকারের রোষানলে পড়ে এই দলের অনেকেই হয়তো দেশে ফিরতে পারবেন না তবুও তাঁরা অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। ইরানের এই প্রতিবাদী মূহুর্ত বিশ্ববাসী স্মরণে রাখবে বহুদিন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link