বিশ্বকাপ চুরি ও একটি কুকুরের গল্প

চার বছর পরপর আয়োজিত হওয়া বিশ্বকাপে বিশ্বসেরার ট্রফির জন্য লড়াই করে বিশ্বসেরা দলগুলো। বিশ্বকাপের ট্রফিটা ফুটবলার এবং দর্শকদের জন্য পরম আরাধ্য এক বস্তু। ট্রফি ঘিরে নানা গল্প বাড়িয়ে দিয়েছে এর আকর্ষণ। বিশ্বকাপ ট্রফির আসল উৎপত্তি, বিকাশ, ইতিহাস নিয়ে মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই।  

ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফির প্রথম প্রস্তাব করেন ফিফার তৃতীয় সভাপতি ফরাসি জুলস রিমে। ১৯২৮ সালে পরিকল্পনার পর ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে মাঠে গড়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর। তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের বছরই ট্রফি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় ফরাসি ভাস্কর অ্যাবেল ল্যাফলেরকে।

তিনি ট্রফি নির্মাণ করেন গ্রিক জয়ের দেবি নাইকির আদলে, অষ্টগোলাকার ট্রফি তিনি মাথার উপর উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। শুরুতে ট্রফিটিকে ডাকা হত ‘দ্য ভিক্টরি’ নামে। ৩৫ সেমি উঁচু এবং ৩.৮ কেজি ওজনের ট্রফিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ল্যাপিস লাজুলি নামের মূল্যবান পাথর। এছাড়া চারপাশে দেয়া হয়েছিল সোনার প্রলেপ, যেখানে প্রতি বিশ্বকাপ শেষে খোদাই করা হত বিজয়ীর নাম।

প্রথম বিশ্বকাপের সময় কন্তে ভার্দে নামের ইতালিয়ান এক জাহাজে করে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে যাওয়া হয় উরুগুয়েতে। স্বাগতিকরা সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ভিক্টরিকে রেখে দিয়েছিল নিজেদের দেশেই। তবে চার বছর বাদেই ইউরোপে ফিরেছিল ভিক্টরি, মুসোলিনির ইতালির হাত ধরে। অবশেষে ১৯৪৬ সালে জুলস রিমেটের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ট্রফির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জুলে রিমে ট্রফি। 

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রফি নিয়েই ভালোই বেকায়দায় পড়েছিলেন ফিফার কর্তাব্যক্তিরা পাছে যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। ফিফার তৎকালীন সহসভাপতি ওট্টারিও বারেসি যুদ্ধের পুরোটা সময় ট্রফি লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর বাড়ির জুতার বাক্সে! ১৯৫৪ সালে ট্রফিটির উপরিভাগে খানিকটা উঁচু করা হয় যাতে বিজয়ী দেশগুলোর নাম লেখা যায়। 

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টিকে গেলেও, সমস্যাটা বেঁধে যায় ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ শুরুর চার মাস আগে লন্ডনে এক প্রদর্শনী থেকে চুরি হয়ে যায় জুলেরিমে ট্রফি। মজার ব্যাপার হল ট্রফির পাশেই তিন লক্ষ পাউন্ড মূল্যের ডাকটিকিট থাকলেও সে চুরি করেছিল মোটে ত্রিশ হাজার পাউন্ড মূল্যের বিশ্বকাপ ট্রফিটি।

বিশ্বকাপের ঠিক আগ মূহুর্তে ট্রফি চুরি হয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। একযোগে তদন্তে নামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং লন্ডন পুলিশ। কিন্তু কিছুতেই কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না কিংবদন্তি সব গোয়েন্দারা। অবশেষে অন্ধকারে আলোকছটার মত করেই ট্রফি চুরির কয়েকদিন পর জ্যাকসন ছদ্মনামে এক চিঠি আসে। চিঠিতে দাবি করা হয় ১৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে ফেরত দেয়া হবে বিশ্বকাপ ট্রফি। 

ঠিক করা হয় ২৫ মার্চ চেলসির স্টেডিয়াম স্ট্যানফোর্ড ব্রিজের সামনে টাকাটা পৌঁছে দিলেই কেবল দেখা মিলবে ট্রফির। পুলিশের গোয়েন্দা লেন বাগি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মেয়ার্সের সহকারী পরিচয়ে নকল নোটভর্তি স্যুটকেট হাতে দেখা করতে আসেন তথাকথিত জ্যাকসনের সাথে। সেদিন পুরো এলাকাজুড়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন পুলিশ এবং গোয়েন্দারা। ফলে যা হবার তাই হল, ধরা পড়লেন জ্যাকসন। কিন্তু বিশ্বকাপ?

মজার ব্যাপার হল জ্যাকসন আসলে ট্রফির হদিশ জানতেন না। এমনকি ট্রফি চোরের সহযোগী তো দূর, তাঁকে দেখেননি পর্যন্ত। তাঁর আসল নাম এডওয়ার্ড ব্যাচলি। জানান দ্য পুল নামের এক ব্যক্তি ৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে স্ট্যামফোর্ডের কাজটি করতে বলেন। ব্যাচলির দুই বছরের জেল হলেও বিশ্বকাপ ট্রফি রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই। 

ইংল্যান্ড জুড়ে যখন বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য তোলপাড় চলছে, তখন ডেভিড করবেট তাঁর কুকুর পিকলসকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি এসে একটি ফোনকলের জন্য বুথের দিকে এগিয়ে যেতেই পিকলস পাশের ঝোপ থেকে একটি ব্যাগ টেনে বের করে। প্যাকেট খুলতে প্রথমে ভয় পেলেও পরবর্তীতে করবেট বুঝতে পারেন কি অমূল্য রত্ন পেয়ে গিয়েছেন তিনি! 

এরপরের ঘটনা অনুমেয়। হতবিহবল অবস্থায় করবেট ব্যাগ নিয়েই ছুটে যান স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে। মূহুর্তের মাঝেই করবেট এবং পিকলস পরিণত হন জাতীয় বীরে। পিকলস তো রীতিমত টিভি তারকা হয়ে ওঠে, একটি চলচ্চিত্রেও দেখা গিয়েছিল এই কুকুরকে। পরবর্তীতে বিশ্বকাপ জিতে জুলেরিমে ট্রফি ইংল্যান্ডেই রেখে দিয়েছিল ববি মুরেই দল। 

তখন নিয়ম ছিল কোনো দল তিনবার ট্রফি জিততে পারলে চিরতরে নিজেদের করে নিতে পারবে জুলেরিমে ট্রফি। ১৯৭০ সালে নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতে সেই শর্ত পূরণ করে ব্রাজিল এবং জুলেরিমে ট্রফি নিজেদের করে নেয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে সিবিএফের অফিস থেকেই দ্বিতীয় বারের চুরি হয়ে যায় জুলেরিমে ট্রফি।

এরপর আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি ট্রফিটি, ধারণা করা হয় ট্রফিটি গলিয়ে সোনা বের করে ফেলেছেন চোর। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ট্রফির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন, এখনো সেই রেপ্লিকাই প্রদর্শিত হয়ে ব্রাজিলের জুলেরিমে ট্রফি হিসেবে। 

১৯৭০ সালে জুলেরিমে ট্রফি ব্রাজিল নিজেদের করে নেয়ার পর বর্তমানের বিশ্বকাপ ট্রফিটি নির্মাণ করে ফিফা। সাত দেশ থেকে ৫৩টি মডেল পাঠানো হলেও বেছে নেয়া হয় ইতালির ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগার মডেলটিই।

৩৬ সেমি লম্বা এবং প্রায় সাড়ে ছয় কেজি ভারী বর্তমানের ট্রফিটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ। বিশ্বকাপ জয়ী প্রতিটি দলের নাম খোদাই করা হয়ে থাকে বিশ্বকাপের ঠিক নিচের অংশে। ব্রাজিলের সাথে ঘটা দুর্ঘটনা থেকে সতর্ক করে ফিফা নিরাপত্তা বলয় বাড়িয়ে দিয়েছে বর্তমান ট্রফির। জুরিখ কড়া নিরপাত্তায় থাকা ট্রফিটি কেবল খুব অল্প সময়ের জন্যই বাইরে আনা হয়।

বেশিরভাগ সময়েই ব্যবহার করা হয় রেপ্লিকা ট্রফিটি। যেসব দল বিশ্বকাপ জিতে নেয়, তাঁরা চার বছরের জন্য রাখতে পারেন  বিশ্বকাপের আদলে তৈরি ব্রোঞ্জের ট্রফিটাই। কেবলমাত্র ২০১০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে চিরতরের জন্য উপহার দেয়া হয়েছিল একটি রেপ্লিকা ট্রফি।

তবে মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষ, যেমন, ফিফা সভাপতি এবং বিশ্বজয়ী ফুটবলাররা স্পর্শ করতে পারেন জুরিখে থাকা ফিফা বিশ্বকাপের আসল ট্রফিটি। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে যে ট্রফি ভ্রমণে বের হয়, সেটাও আসল নয়, বরং রেপ্লিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link