১.
১৯৩০ এ সেই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল, যার শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার মাঠে। আর তারপর থেকেই শুরু হল দেশজুড়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের ডমিনেশন। জার্মানির ফ্যুয়েরার হয়ে উঠলেন হিটলার আর শিল্পের দেশ ইতালিতে ‘ডিউস’ মুসোলিনি শুরু করলেন একাধিপত্য। ফলে ১৯৩৪, ১৯৩৮’র হয়ে উঠল কার্যত এক নায়কতন্ত্রের বিশ্বকাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশ্য ছবি বদলালেও, ইউরোপেই কায়েম থাকল ফিফা বিশ্বকাপের দামামা।
১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপ ব্রাজিল জেতার পর থেকেই এবার হুঙ্কার আসতে শুরু করল প্রশান্ত মহাসাগরের ওপার থেকে। বয়কটের হুঙ্কার। কেন? দক্ষিণ আমেরিকায় বিশ্বকাপের আয়োজন ফেরত চাই! ঠিক যেন ১৯৩৮ বিশ্বকাপের ছবি। সেবারেও দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার অনেক টিম বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচারের প্রতিবাদে। কিন্তু এবারে আর ফিফা রিস্ক নেয়নি। আয়োজকদের জন্য ভোট গণনা শুরু হল।
শেষমেষ তা হল। হল, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা উরুগুয়েতে নয়। ফেভারিটের দৌড়ে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জায়গা করে নিল আন্দিজ পর্বতের কোলে অবস্থিত চিলিতে। ১৯৬২ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পেল চিলি এবং তারপরেই, ১৯৬০ সালের ২২ মে – ঘটল মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকরতম ভূমিকম্প! ১০ মিনিট ধরে চলা তীব্রতম ভূমিকম্প, ইতিহাসে যা বিখ্যাত হয়ে আছে ‘দ্য ভালদেভিয়া আর্থকোয়েক’ নামে।
ভূমিকম্পের জেরে ধূলিসাৎ হয়ে গেল চিলির তালকা, চিলো আইল্যান্ড, শয়ে শয়ে গ্রাম এবং তলতেন শহর। ক্ষতিগ্রস্ত হল স্যান্টিয়াগো শহরও, তার সঙ্গে চিলির ফুটবল ফেডারেশনের ঠিক করে রাখা আটটা ভেন্যুর মধ্যে চার-চারটে ভেন্যু। এই ভূমিকম্পের বিশ্বব্যাপী ফল হল মারাত্মক। কারণ, ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া এই ভূমিকম্পের জেরে অনেক দেশই চিলিতে পা রাখতেই চাইল না। শুধু তাই নয়, চিলির নিজস্ব গভর্নমেন্টও চাইল না যে বহু কষ্টে অর্জিত বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব আর তাদের ঘাড়ে বহন করতে।
কিন্তু, দ্যাট ওয়াস দ্য পাওয়ার অফ দেম – বিশ্বকাপের আয়োজক যখন হয়েছি, শেষ দেখে ছাড়ব! শুরু হল রিপেয়ারিং এবং ১ বছরের মধ্যে স্যান্টিয়াগো-সহ বহু ভেন্যুকে আগের মত সাজিয়ে উঠতে পারল চিলি সরকার। আয়োজক চিলি সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষতি থেকে রিকভার করে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন, করে দেখিয়েছিল গোটা বিশ্বকে।
২.
গ্রুপ পর্বে একই সঙ্গে রয়েছে চিলি এবং ইতালি। ইতালি সেই ১৯৩৪ আর ১৯৩৮-এর পর (ফ্যাসিস্ট সরকারের বদান্যতায়) আর বিশ্বজয়ের মুখ দেখেনি। অন্যদিকে, চিলি একেবারেই ফুটবলের পরিভাষায় ‘আন্ডারডগ’ টিম। আয়োজক দেশ হিসেবে খেলছে, এছাড়া এর আগে দু’বার অংশগ্রহণ করে দু’বারই গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। টপ ফেভারিট টিম হিসেবে ব্রাজিল সেবার ‘৫৮ এর বিশ্বজয়ী স্কোয়াড থেকে ন’টা হোল্ড ওভার নিয়ে এসেছিল।
শুরু থেকেই যদিও দুটো দেশের মধ্যে বাতাবরণটা স্বস্তির ছিল না। চিলি বিশ্বকাপ কভার করতে ইতালি থেকে উড়ে এসেছিলেন দু’জন সাংবাদিক। তাদের একজন কোরাদো পিজিনেল্লি, অন্যজন অ্যান্টোনিও ঘিরেদেল্লি। এই শেষোক্ত সাংবাদিকটি একদিন লিখে বসলেন এমন একটা আর্টিকেল, যা রীতিমত অস্বস্তিকর। এবং তাতে ছিল এই লাইনটি – ‘Santiago is a backwater dump where the phone’s doesn’t work, taxis are as rare as faithful husbends, a cable to Europe costs an arm and a leg and a latter takes five days to turn up!’
লা নাজিওন দৈনিকে এই ধরণের কথা প্রকাশ অধিবাসীরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই একেবারেই ভাল চোখে নেয়নি। শুরু হয়ে গেল একটা চাপা ঠাণ্ডা লড়াই। পিজিনেল্লি এবং ঘিরেদেল্লি ক্লেম করতে থাকলেন যে তাদের রিপোর্ট, প্রতিবেদন সব বিকৃত করা হচ্ছে কিন্তু সে কথায় কর্ণপাতও করেনি চিলি গভর্নমেন্ট। উল্টে, একজন আর্জেন্টাইন সাংবাদিকই একদিন ভুল করে চিলির বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে লিখে ফেলে একটি অপ্রীতিকর প্রতিবেদন, যার ফলস্বরূপ একটা বারে একদিন সন্ধ্যায় কিছু উন্মত্ত চিলি জনতার হাতে প্রহৃত হন।
এসব দেখেশুনে এবং চিলিতে হাওয়া খারাপ বুঝে প্রাণ বাঁচাতে ঐ দুই সাংবাদিক চটজলদি ফ্লাইটে পালিয়ে যান দেশে— একেই ভূমিকম্প থেকে সদ্য উঠে আয়োজন এবং দেশ হিসেবেও কমজোরি, কিন্তু ইউরোপের মালিক সুলভ জারিজুরি চিলিতে খাটেনি। ইতালিয় মিডিয়ার ভাষায় – ‘Santiago out to be a poverty-striken dump full of crime and loose women.’
এদিকে শুরু হল ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৬২। গ্রুপ পর্বের প্রথম খেলায় এস্তাদিও ন্যাশিওনালে চিলি ৩-১ গোলে হারায় সুইজারল্যান্ডকে। চিলির বিখ্যাত স্ট্রাইকার লিওনেল স্যাঞ্চেজ একাই করেন দু’গোল। সেই বিশ্বকাপে মোট ৪ গোল করেন স্যাঞ্চেজ। অন্যদিকে প্রথম ম্যাচে ইতালি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে। এখন চিলি যদি নেক্সট ম্যাচে জিতে যায়, তবে সরাসরি নেক্সট রাউন্ডে কোয়ালিফাই করবে, কিন্তু ইতালি জিতলে গল্প একটু ঘুরে যাবে। সবশুদ্ধ ১২টা দেশ সেবার অংশ নিয়েছিল, তাই পরের রাউন্ডেই কোয়ার্টার ফাইনাল।
৩.
এস্তাদিও ন্যাশিওনাল স্টেডিয়াম, চিলি। ২ জুন ১৯৬২, ঐতিহ্যবাহী গাঢ় নীল শার্ট আর সাদা প্যান্টে ইতালি টিম এসে ঢুকল স্টেডিয়ামে। অন্যদিকে লাল শার্ট আর নীল প্যান্ট পরিহিত চিলি খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ পর্যন্ত বিনিময় হয়নি খেলার আগে, বিনিময় হয়েছিল থুতু!
যার জেরে গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে বারবার ইতালির খেলোয়াড়দের দিকে অশ্রাব্য গালিগালাজ এবং খেলার পরিভাষায় ‘বু’ করতে থাকে। সারা স্টেডিয়ামে ইতালির উদ্দেশ্যে চলে থুতু ছিটানোর প্রতিযোগিতা! উত্তেজনায় ফুটছে গোটা মাঠ, এমন সময় ব্রিটিশ রেফারি কেন অ্যাস্টন কিক অফ শুরু করলেন। শুরুর ১২ সেকেন্ডে ঘটল প্রথম ফাউল! শুরু হল মারামারি! এইভাবে খেলা শুরু পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা গোটা মারামারিকে প্রায় একার হাতে বন্ধ করলেন কেন অ্যাস্টন!
যদিও ঠিক ১২ মিনিটের মাথায়, অনারিও ল্যান্ডারকে মারাত্মক ভাবে ফাউল করলেন ইতালিয় মিডফিল্ডার জিওর্জিও ফেরিনি। প্রতিশোধের ফাউল ছিল সেটা। রেকলেস চ্যালেঞ্জ এবং অ্যাস্টন রেড কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। আর ফেরিনির মাথা যায় গরম হয়ে! চিৎকার-চেঁচামেচি করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন রেফারিকে, লাথি মারেন পাশে দাঁড়ানো এক চিলিয়ান ডিফেন্ডারকে! মাঠে ঢোকে পুলিশবাহিনী, তারাই সরিয়ে নিয়ে যায় ফেরিনিকে। এই যুদ্ধ চলেছিল ক্রমাগত ৮ মিনিট ধরে, গোটা মাঠ জুড়ে ছেষট্টি হাজার দর্শকের গর্জনের সামনে!
খেলা আবার শুরু হল। এরপর, ঠিক হাফ টাইমের আগে, ৪৩ মিনিটের মাথায় বাঁ-দিকে একটা বল পেলেন লিওনেল স্যাঞ্চেজ। তাড়া করতে গেলেন রাইট ব্যাক মারিও ডেভিড এবং আবার করে বসলেন এক বিশ্রী ফাউল! একেবারে হাত দিয়ে প্রায় থাপ্পড় মারার ভঙ্গীতে মুখ সরিয়ে দিয়ে টাচলাইনের ধারে ছিটকে ফেলে দিলেন। কিন্তু, উইদিন আ ফ্র্যাকশন অফ এ সেকেন্ড, পেশাদার বক্সারের ছেলে লিওনেল স্যাঞ্চেজ ঝেড়ে উঠেই বসিয়ে দিলেন মারিও ডেভিডের চোয়ালে এক ঘুঁষি! দু’হাত দূরেই লাইন্সম্যান, তিনি এবং রেফারি দেখেও দেখেননি।
কিন্তু এরপরেই, উড়ে এসে বুট দিয়ে স্যাঞ্চেজের মাথায় বাজে আঘাত করেন মারিও ডেভিড! ফল?পকেট থেকে আবার একবার রেড কার্ড বার করতে হল কেন অ্যাস্টনকে। প্রথম হাফ শেষ হতে সে ম্যাচে সময় লেগেছিল প্রায় ৬০ মিনিটের কাছাকাছি!
এইভাবে গোটা ম্যাচ জুড়ে ক্রমাগত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে চলা ইতালির খেলোয়াড়রা শেষ পর্যন্ত হেরেই মাঠ ছাড়ে। ৪-২-৪ এ নেমেছিল ইতালি এবং সেটা পরবর্তীতে হয়ে গেল ছন্নছাড়া। ২জন রেড কার্ড এবং অপর্যাপ্ত ট্যাকেল, মারের বিনিময় মার চলতে থাকায় ইতালির ছন্দ শুরু থেকেই কেটে গেছিল।
বদলে ৪-৩-৩ এ নামা চিলি খেলেছিল ছন্দে। ৭৩ মিনিটের মাথায় রামিরেজ ১-০ তে এগিয়ে দেওয়ার পর ওখানেই গল্প শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পেরেকটা পুঁতে আসেন তোরো, ৮৭ মিনিটের মাথায়। সেই গোলটা আবার অ্যাসিস্ট করেন সারা ম্যাচে কমপক্ষে কুড়ির বেশিবার মার খাওয়া লিওনেল স্যাঞ্চেজ।
ফুটবল ইতিহাসে এই ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে ‘দ্য ব্যাটল অ স্যান্টিয়াগো’ নামে। ব্যাটল না বলে অবশ্য ফাইট বলাই বাঞ্ছনীয়! এখানে রেফারি কেনেথ অ্যাস্টনের কথা একটু বলা দরকার। তখনও পর্যন্ত ফাউলে শুধুই রেড কার্ড দেখানোর প্রচলন ছিল। এই ভদ্রলোকই এসে নিয়ম পাল্টালেন। ইতিহাসে সেই প্রথম ব্যবহার হল হলুদ কার্ডের (সেই ম্যাচে বহু সংখ্যক হলুদ কার্ডের আশু প্রয়োজন ছিল!)।
চিলি সেবার শেষ ম্যাচে যদিও পশ্চিম জার্মানির কাছে হারে, তবু পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছিল এবং সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল – যা আজও বিশ্বকাপে তাদের সর্বোচ্চ ফল। ব্রাজিলের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। অন্যদিকে ইতালি শেষ ম্যাচ জিতলেও ভাগ্য এক প্রকার লেখা হয়েই গিয়েছিল তাদের। ন্যক্কারজনক ভাবে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাদের।
ফুটবল সুন্দর, ফুটবল নৃশংস, ফুটবল কখনও বা পাঁকের মাঝে ফুটে থাকা পদ্ম। যারা জানে, তারা জানে। ব্যাটল অব স্যান্টিয়াগো, মিরাকেল অফ বার্ন – বারে বারে সে গল্পই বলে গেছে ইতিহাসের আড়ালে।