শেষবার ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপের শেষ ষোলতে উঠেছিল মরক্কো। ৩৬ বছর পর এসে, এবার সেই সাফল্যই স্পর্শ করলো আফ্রিকার দলটা। গ্রুপে বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়ার মতো ইউরোপের জায়ান্ট দল থাকলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই প্রথম পর্বের বাঁধা পার করলো মরক্কোনরা।
মরক্কোর তিন যুগের এ অপেক্ষার অবসান ঘটানোর মূল দায়িত্বটা নিয়েছিলেন হাকিম জিয়েচ। কানাডার বিপক্ষে ড্র হলেই চলতো। তবে ম্যাচের ৪ মিনিটের মাথায় কানাডার গোলরক্ষকের ভুলে বল পেয়ে যান জিয়েচ। তখন ফাঁকা হয়ে যায় কানাডার গোলপোস্ট।
আর সেখান থেকে গোল করতে ভুল করেননি তিনি। এর মধ্য দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দ্রুততম গোলের পাশে নাম লেখান জিয়েচ। একই সাথে, ঐ গোলেই ক্রোয়েশিয়াকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে এগিয়ে যায় মরক্কো।
মরক্কোর এমন পুনর্জাগরণের গল্পগাঁথায় শুধু কানাডা নয়, হারাতে হয়েছে ফিফা র্যাংকিংয়ের দুই নম্বর দল বেলজিয়ামকেও। আর সে ম্যাচেও দুর্দান্ত এক অ্যাসিস্ট করেছিলেন জিয়েচ। টানা দুই ম্যাচে দুর্দান্ত পারফর্ম করা জিয়েচকে নিয়ে তাই আলোচনাটা ঘুরেফিরেই আসছে, সামনেও হয়তো আসবে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই জিয়েচের এবার বিশ্বকাপ খেলারই কথা ছিল না। এক প্রকার অবসরের ঘোষণাই দিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এর পিছনে ছিল মরক্কোর কোচের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব।
মরক্কোর কোচ তখন ভাহিদ হালিলহোদিচ। তো জিয়েচের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে ২০২১ এর জুনে। সে সময় তিনি অভিযোগ তোলেন, মরক্কোর হয়ে প্রীতি ম্যাচ না খেলার জন্য ভুয়া চোটের অজুহাত দেখিয়েছিলেন জিয়েচ। অবশ্য সবসময়ই সেটি অস্বীকার করে এসেছেন জিয়েচ। তবে সময় গড়াতে গড়াতে কোচের সাথে তাঁর মনোমালিন্যও বাড়তে থাকে।
আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকান ন্যাশন্স কাপের জন্য মরক্কোর স্কোয়াড থেকে জিয়েচকে বাদ দিয়ে দেন হালিলহোদিচ। এমনকি তাঁর অধীনে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বেও দলের বাইরে ছিলেন জিয়েচ। আর এরপরেই জিয়েচ দিয়ে ফেলেন তাঁর অবসরের ঘোষণা। জানিয়ে দেন, তিনি আর জাতীয় দলে ফিরছেন না। এমনকি এটাও জানিয়ে দেন, এটাই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তবে বিশ্বকাপের আগে মরক্কোর কোচিং প্যানেলে একটা পালাবদল ঘটে। হালিলহোদিচের জায়গায় মরক্কোর কোচ হয়ে আসেন ওয়ালিদ রেগরাগুই। আর দায়িত্ব নেওয়ার পরেই তিনি আলাদা করে জিয়েচকে দলে ফেরানোর ব্যাপারে তৎপর হন। ২৮ বছর বয়সী জিয়েচও তেমন একটা অনাপত্তির সুর তোলেননি। কোচের অনুরোধে ফিরে আসেন মরক্কোর জাতীয় দলে। আর এসেই দলকে নিয়ে গেলেন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। যে গ্রুপে মরক্কো পড়েছিল, সেখানে তাদের সম্ভাব্য ৪র্থ স্থান ধরেও অনেকে হিসেব কষেছিল। কিন্তু সকলের হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরে রাউন্ড নিশ্চিত করলো মরক্কো।
মরক্কোর হয়ে খেললেও হাকিম জিয়েচের জন্ম কিন্তু নেদারল্যান্ডসে। পেশাদার ফুটবলের শুরুটা ডাচ দূর্গ থেকেই। ডাচ ক্লাব হীরেনভিনের হয়ে পেশাদার ফুটবলের শুরু করেছিলেন জিয়েচ। এরপর গায়ে জড়িয়েছেন এফসি টুয়েন্টি, আয়াক্সের জার্সি। আর এর মাঝে নেদারল্যান্ডস অনূর্ধ্ব-২১ দলেও খেলেছিলেন। তবে ২০১৫ সালে তিনি পাড়ি জমান তাঁর মায়ের জন্মভূমি মরক্কোতে। এরপর সেই মরক্কোর হয়েই তিনি খেলার সিদ্ধান্ত নেন। আর ২০২০ সালে তিনি আয়াক্স ছেড়ে ক্লাব ফুটবলে পাড়ি জমান ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে।
হাকিম জিয়েচ মূলত খেলোয়াড় হিসেবে অনেকটা সব্যসাচী ঘরানার। তিনি রাইট উইংগার হিসেবেও খেলতে পারেন। আবার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে পারেন। আর তাঁর ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রোলে খেলার সক্ষমতার কারণেই মরক্কো এবার সুফলটা পেয়েছে। পুরো বিশ্বকাপে মরক্কোর জন্য যেন মধ্যমাঠের প্রাণ হয়ে ছিলেন তিনি। বল মেকিং, চান্স ক্রিয়েট, এমনকি স্কোরিং- সব কিছুতেই এবারের বিশ্বকাপে নিজের আলাদা একটা সাক্ষর রাখতে পেরেছেন তিনি। আর সেই যাত্রায় দলকেও নিয়ে গিয়েছেন গ্রুপের শীর্ষে।
শেষ ১৬ তে মরক্কোর প্রতিপক্ষ স্পেন। দিন তিনেক বাদেই তারা ইউরোপিয়ান এ জায়ান্টের সাথে মুখোমুখি হবে। মরক্কোর এর আগের সেরা সাফল্য, ৮৬-র বিশ্বকাপে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে উর্ত্তীর্ণ হওয়া। সে সময়ের প্রি-কোয়ার্টার মানেই এখনকার রাউন্ড অফ সিক্সটিন। তাই ইতিহাসের সেরা সাফল্য তারা ইতোমধ্যেই স্পর্শ করে ফেলেছে। এখন দেখার পালা সেই সাফল্য তারা এবার টপকে যেতে পারে কিনা। তবে সেই যাত্রার দৌড়ে সন্দেহাতীতভাবেই চোখ রাখতে হচ্ছে জিয়েচের উপর।