আজিজ বেহিচ, ওগুলো ক্রিকেটে হয়, মেসির সঙ্গে তো নয়ই

মিস্টার আজিজ বেহিচ, ওগুলো ক্রিকেটে হয়।

ব্যাটসম্যানকে দাঁত খিঁচোবেন। গালমন্দ করবেন। সবাই মিলে ঘিরে ধরে ভয় দেখাবেন। বাইশ গজে বেচারী একা ব্যাটসম্যান ভয়ে জুজু হয়ে যাবেন। আর আপনারা আপেল চাষ করে যাবেন। ক্রিকেটদুনিয়া তো আপনাদের এই ‘বীরত্ব’ দেখে নতজানু হয়ে থেকেছে। আপনারা গর্ব করে একে স্লেজিং বলেন। কলার তোলেন ঔদ্ধত্যে। ফিচেল হাসি দেন।

আজিজ বেহিচ, ওগুলো ক্রিকেট মাঠে করবেন। হয়তো সফলও হবেন। অনেকে ভয় পাবেন। অনেক ভয় পাবেন না। ফুটবলমাঠে ওসব করতে যাবেন না। আর উল্টোদিকে যদি লিও মেসি থাকেন, তাহলে তো নয়ই।

কাল মধ্যরাতে আপনি নায়ক হতে পারতেন অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু দিনের শেষে আপনি খলনায়ক। আপনি সমালোচনায় সমালোচনায় জেরবার। আসামীর কাঠগড়াতেও হয়তো আপনাকে তোলা হচ্ছে বা হবে।

খেলার শেষের দিকে একটা গোলের জন্য যখন গোটা অস্ট্রেলিয়া মরিয়া, তখন আর্জেন্টাইন ডিফেন্সকে ফালাফালা করে দিয়ে আপনি প্রায় গোল করে ফেলেছিলেন। গোলটা হয়ে গেলে আর্জেন্টিনারই দমবন্ধ হয়ে যেত। এবারের টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোলটা আপনার নামেই লেখা হত। কিন্তু ফুটবল-দেবতা অন্য চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন মেসির জন্য। না লিখে রাখলে ঘোরতর অন্যায় হত।

আজিজ বেহিচ, আপনি মাস্তান সাজতে গিয়ে কী করলেন, তা হয়তো এতক্ষণে উপলব্ধি করেছেন। বিরতির মিনিট দশেক আগে মেসির কলার ধরে কেন টানলেন? কেন? কেন? কেন?
কেন নিজের দলকে বিপন্ন করলেন? আপনার ওই নাম কা ওয়াস্তে ‘শিভ্যালরি’ যে কতটা ক্ষতি করে দিল আপনার দেশকে, তা হয়তো সেই ক্ষণে আপনি বুঝতেও পারেননি।

কী দরকার ছিল মেসির জার্সি ধরে টানার? আপনি গুণ্ডামি করতে গেলেন। চোয়াল শক্ত করে দু-চার কথা বললেন মেসিকে। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানা নেই, মেসিরও চোখ লাল হয়ে উঠেছিল। মেসি যে আপনার থেকেও বড় গুণ্ডা। র‌্যামোস-পেপেরা যেভাবে রক্তাক্ত করেছেন মেসিকে, সেই জায়গায় আপনার কলার টানা। আপনি ভাবলেন মেসি বুঝি ভড়কে যাবেন। কিন্তু তিনি যে অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। আপনাদের ওসব স্লেজিং-ফ্লেজিং কাজ করবে না এখানে।

আজিজ বেহিচ, আপনার কলার টানা বুমেরাং হয়ে ফিরল যে! কাল ম্যাচে ওই একটা মুহূর্তেই মেসির চোখ লাল হয়ে উঠেছিল। বিদেশি মিডিয়া বলছে, মেসিজ আইস টু উড টার্ন ক্রিমসন। ইট ভাঁটায় ইট যখন পোড়ানো হয়, তখন লাল রংয়ের যে আভা বেরোয় সেটাই ক্রিমসন রং। অনেকে আবার বলেন ক্রিমসন ক্রেমলিন। যাক গে যাক সে সব কথা।

আপনাদের দু’ জনের মধ্যে দূরত্ব কমে গিয়েছিল। আপনি তেড়ে গিয়েছিলেন মেসির দিকে। আপনার চোখে খেলা করছিল আগুন। আগুন নিয়ে খেলা ভাল নয় আজিজ বেহিচ!

রেফারি গিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন আপনাকে। মেসির সতীর্থ ম্যাক অ্যালিস্টার পরে বলছিলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে মেসির ভিতরে আগুন জ্বলে উঠে। ও তখন নিজের সেরাটা বের করে। মেসির এহেন ব্যক্তিত্ব তাঁকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।’

মেসিকে মাঠে কেউ রাগতে দেখেছেন? শেষবার এমন রাগ করতে কবে দেখা গিয়েছে? মেসি-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, কোপা আমেরিকার সময়ে। কলম্বিয়ার স্ট্রাইকার মিনা পেনাল্টি নষ্ট করায় মেসি কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ”এবার নাচতে থাকো।” মিনা গোল উদযাপনের সময়ে নাচেন। মেসির নিশানায় সেই নাচ, সেই মিনা।

বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেসি কিন্তু মুখে কিচ্ছুটি বলেননি। তাঁর বাঁ পা জবাব দিয়েছে। নিজে ফ্রি কিক নিলেন। আবার তিনি নিজে গিয়েই গোল করে এলেন। তিন জনের চক্রব্যূহর মধ্যে থেকে বল ঠিক জায়গায় রাখলেন। রিপ্লেতে যখন গোলটা দেখাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ান গোলকিপারের হাতের কাছে গিয়ে বলটার গতি যেন বহুগুণে বেড়ে গেল। এ কি ম্যাজিক? নাকি অন্য কিছু।

আজিজ বেহিচ, আপনি নিশ্চয় নিজেকে অপরাধী বলে মনে করছেন। আপনার শরীরে তুরস্কের রক্ত। আপনার বাবা এয়াসের একসময়ে নামী ফুটবলার ছিলেন। সত্তরের দশকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছিলেন। এতটাই ভাল ফুটবল খেলতেন আপনার বাবা যে চিউয়িং গামের র‌্যাপারে আপনার বাবার ছবি আঁকা থাকত। আরও বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে আপনার বাবা চলে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। ফ্যাক্টরি ধোওয়া মোছার কাজ করতেন। পাঁচ সন্তানের মধ্যে আপনি চতুর্থ। একমাত্র ছেলে আপনি আজিজ বেহিচ। বেড়ার ওপার থেকে আপনি দেখেছেন, আপনার বাবা বল মারছেন।

আজিজ বেহিচ, আপনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার শরীরে তুরস্কের রক্ত। তবে মনে প্রাণে অস্ট্রেলিয়ান। অস্ট্রেলিয়া আমাকে সুযোগ দিয়েছে। আমিও প্রতিদানে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই।’

আপনি কিন্তু অনেক কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারতেন কাল রাতে। দিনের শেষে আপনি শূন্য হাতে ফিরছেন। আর ওই ছবিটাও স্মৃতিতে বহুদিন থেকে যাবে। খেলার শেষে হতাশায়, দু:খে আপনি উপুর হয়ে শুয়ে রয়েছেন সবুজ মাঠে। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে পালাসিয়স অবাক চোখে দেখছেন আপনাকে। আপনি নিশ্চয় বলছিলেন, “ধরণী দ্বিধা হও।”

আজিজ বেহিচ কেন আপনি মেসিকে রাগাতে গেলেন? কেন? কেন? কেন? ওগুলো ক্রিকেটে চলে। ফুটবলে নয়। মেসির সঙ্গে তো নয়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link