দীপক চাহারের করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলটা, খানিকটা হাওয়ায় ভাসিয়ে কভার অঞ্চলে ঠেলে দেন মেহেদি হাসান মিরাজ। এরপর রীতিমত এক আনন্দ বন্যা বয়ে যায় গোটা মিরপুর জুড়ে। সেটা ক্রমেই ছড়িয়ে যায় পুরো দেশে। ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্মাদনাকে ছাপিয়ে।
নিশ্চয়ই বিশেষত্ব একটা ছিল সেই ইনিংসটার। অবশ্যই ছিল। ভারতের বিপক্ষে নিকট অতীতে এমন বহু ক্লোজ ম্যাচ বাংলাদেশ হেরেছে। তেমনই একটা উদাহরণ হয়ে যেত পারত হোম অব ক্রিকেটে। ভারতকে স্বল্প রানে আটকে ফেললেও, ব্যাটারদের অপারগতায় ম্যাচটা হারতে বসেছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন মেহেদি মিরাজ।
মেহেদি হাসান মিরাজ, বাংলাদেশ ক্রিকেটে খুব একটা লাইমলাইট পাওয়া চরিত্র নয়। তবে তাঁর সাথে যে অন্যায় হচ্ছে সেটা বারেবারেই মনে করিয়ে দেন মিরাজ। কেবল তাঁর বোলিং সত্ত্বাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় জাতীয় দলে। অথচ ব্যাট হাতেও মিরাজ সমান কার্য্যকরী, যথেষ্ট সাবলীল। তবুও তাঁর অবস্থান লোয়ার অর্ডারে।
টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটে না। টি-টোয়েন্টিতে আরও বেশি ব্রাত্য মিরাজ। সেখানে নিয়মিত একাদশেই সুযোগ পান না। তবুও তিনি হাল ছেড়ে দেন না। নিজের একটা আলাদা পরিচয় তিনি প্রতিনিয়ত তৈরি করতে মুখিয়ে থাকেন। একজন অলরাউন্ডার মিরাজ হিসেবেই তিনি পরিচয় করিয়ে দিতে চান নিজেকে।
তবে তিনি সুযোগটা ঠিক পাননা। প্রতিটা সময় ভীষণ চাপের মুখে তাঁকে নামতে হয় ব্যাট হাতে। বাইশ গজে সবাই যখন ব্যর্থ, ঠিক তখন। দলগত ব্যর্থতার দিনে মিরাজও ভেঙে পড়বেন। এমন প্রত্যাশাই হয়ত করে সকলে। তবে মিরাজ প্রতিটা সময় মুগ্ধ করেছেন। তিনি তাঁর শরীরি ভাষায় বলেছেন, ‘চাপে আমি ভেঙে পড়ি না’। তিনি ম্যাচের শেষ অবধি বিশ্বাস করেন তিনি ম্যাচ জেতাতে পারবেন।
তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের নিয়মিত অধিনায়কও ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন বহু সময়। একবার তামিম ইকবাল বলেন, ‘যদি প্রতিপক্ষের জয়ের জন্য পাঁচ রান প্রয়োজন হয় এবং ছয় উইকেট তাদের হাতে থাকলেও মিরাজ তখনও বিশ্বাস করতে চায় সে জিতবে।’
ঠিক এতটা মানসিকভাবে দৃঢ় ছোট্ট গঢ়নের মিরাজ। তাইতো ভারতের তুখোড় বোলিং লাইনআপের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি পরপর দুই ইনিংসে বাংলাদেশকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুললেন। প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৩৮টি রান বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল ঐতিহাসিক এক জয়। দশম উইকেটে তিনি রাজ্যের সব চাপ সামলে ব্যাটিং করে গেছেন। যদিও অপরপ্রান্ত থেকে আস্থা জুগিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
হয়ত সবাই ভেবে বসতেই পারে অমন দু’একটা ইনিংস খেলাই যায়। ভেবেছেও অনেকে। তকমা দেওয়া হয়েছে ‘মিরাকল মিরাজ’। তবে না, মিরাজ কালেভদ্রে এমন ইনিংস খেলেন না। তিনি রীতিমত একজন ভাল মানের ব্যাটার, সেটা তিনি সুযোগ পেলেই প্রমাণ করেন। এই যে যেমন ভারতের বিপক্ষেই সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও তিনি তাই করলেন। দল যখন আবারও ব্যাটিং বিপর্যয়ের দ্বারে, তখন আস্থা হয়ে মিরাজ হাজির। তিনি যখন ব্যাটিং করতে নামলেন তখন বাংলাদেশের স্কোর ৬৯, ছয় উইকেট হারিয়ে।
এমন একটি পরিস্থতিতে তিনি জুটি বাঁধলেন অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সাথে। ১৪৮ রানের জুটি গড়েন দু’জনে মিলে। রিয়াদ খানিকটা ধীরস্থির শুরু করলেও মিরাজ যথারীতি ছিলেন সাবলীল। একটা সময় রিয়াদ দলের ২১৭ রানের মাথায় ব্যক্তিগত ৭৭ রানে আউট হয়ে গেলেন। তবে মিরাজ তখনও তাঁর ব্যাটের লড়াই চালিয়ে গেলেন। বাংলাদেশকে ২৫০ রানের গণ্ডি পার করালেন। নাসুম আহমেদও অপরপ্রান্তে নির্ভার হয়ে ব্যাট চালালেন।
বিপর্যয় সামলে মিরাজ তুলে নিলেন নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। দলকে ৬৯ থেকে ২৭১ অবধি পৌঁছে দিয়েই তবে মাঠ ছাড়লেন মিরাজ। আরও একটি অপরাজিত ইনিংস যুক্ত হল। মিরপুর কখনোই খুব ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেট নয়। তবুও এই উইকেটে ভারতীয় বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে চোখে চোখ রেখেই লড়াইটা করেছিলেন মিরাজ।
এই দুইটি ইনিংসই যথেষ্ট ব্যাটার মিরাজকে পরিমাপ করবার জন্যে। তবুও ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষের ইনিংসটিও বিবেচনায় নেওয়া যায়। অপরাজিত ৮১টি রান করেছিলেন মিরাজ। ম্যাচটি শেষ করে বাংলাদেশের পক্ষে জয় নিয়েই তবে ফিরেছিলেন। চাপে মিরাজ ভেঙে পড়েন না। তিনি একজন ব্যাটার, এসব কিছুর স্বপক্ষে এই ইনিংসগুলোই তো যথেষ্ট। তাছাড়া টেস্টেও তো তিনি সমান কার্য্যকরি। সেখানেও তাঁর নামের পাশে শতক রয়েছে।
মিরাজ নিজেকে প্রমাণের যথাযথ সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। তাঁর সুযোগগুলো অধিকাংশ সময়েই আসছে নিদারুণ কঠিন সময়ে। তবুও মিরাজের প্রতিটা ধমনীতেই যেন শীতলতা বয়ে বেড়ায় অদম্য গতিতে। তিনি দুর্বার হয়ে ছুটে বেড়াতে চান। তিনি সুযোগ চান, নিজের ক্যারিয়ারটাকে ব্যাটে-বলে বর্ণিল করবার।