চোখে অশ্রু নিয়ে এক মহামানব সবুজ ঘাসগালিচা প্রস্থান করছেন। অন্যদিকে আরেকটা দল অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে আবর্তিত হয়ে নিজেদেরই হারিয়ে ফেলেছে। উচ্ছ্বাস, আবেগ, উন্মত্ততায় নিজেরা যেন এক রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করেছে।
দুটি দৃশ্য। একটা সুখানুভূতির, অন্যটা বিষণ্ণতার। তবে ঐ দুটি দৃশ্যই একেকটা ইতিহাস। অশ্রুসিক্ত হয়ে রোনালদোর প্রস্থান যদি একটা কাব্য হয়, তাহলে মরক্কোর সেমিতে পৌঁছানো হয়ে থাকবে একটা মহাকাব্যের নাম।
আফ্রিকার দরিদ্র জর্জর এক দেশ মরক্কো। আর্থ সামাজিক অবস্থা কিংবা জিপিডি, সব কিছুতেই বাংলাদেশ থেকে ঢের পিছিয়ে থাকা একটি দেশ এই মরক্কো। তাদের অবলম্বন শুধু এই ফুটবল। তবুও সেই অবলম্বনকে কেন্দ্র করে ইতিহাস তেমন সমৃদ্ধ করতে পারেনি দেশটা। ইতিহাস বলতে আছে শুধু, এর আগে ৫ টি বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা। সেই ৫ বারের অভিজ্ঞতাও আবার সুখকর নয়। তিন যুগ আগে ১৯৮৬ সালে সেকেন্ড রাউন্ডে পা রেখেছিল দেশটা। তাছাড়া বাকি চারবারের প্রত্যেকবারই ফিরতে হয়েছিল শূন্য অর্জনে।
মরক্কো এবার সেই শূন্যতাকেই পূর্ণ করার ব্রত নিয়ে এসেছিল কাতারে। তবে নিশ্চিতভাবেই সেটা রুপকথা সমতূল্য নয়। কিন্তু নিজেদের ভাবনারও বাইরে গিয়ে এবার তারা অভাবনীয় সাফল্যে নিজেদের মোড়ালো। শুরুটা হয়েছিল ফিফা র্যাংকিংয়ে ১ নম্বরে থাকা বেলজিয়ামকে হারিয়ে। এরপর রুপকথার গল্পগুলোর কলেবর শুধু বাড়তেই থাকে।
সবার ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে গ্রুপ এফ এর চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে স্পেনের মুখোমুখি হয়েছিল মরক্কো। ইউরোপের সবচাইতে ক্লিনিক্যাল ফুটবল খেলা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম স্পেন। তবে হাকিম জিয়েচ, আশরাফ হাকিমিদের সামনে সেই দৌরাত্মপূর্ণ স্টেটমেন্ট আর ধোপে টিকলো না। গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে ইয়াসিন বোনো মরক্কোকে জিতিয়ে দিলেন। অতীত ইতিহাস বিবেচনায় রুপকথার পূর্ণতা তখনই পেয়ে গেছে।
তবে ওয়ালিদ রেগুরাগুই শিষ্যদের তৃষ্ণা তো সেখানেই শেষ নয়। বরং আরো দুর্দম গতিতে এগিয়ে প্রত্যয়ে পর্তুগালের সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে এসেছিল মরক্কো। সেই গতি এ ম্যাচেও থামেনি। বরং রাউন্ড অফ সিক্সটিনে সুইসদের ৬-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়া পর্তুগালের গতিময় পথযাত্রার একটা ইতির আবহ তৈরি হয় ঐ মরক্কোর বদৌলতেই। পর্তুগিজদের ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাস টপকে আফ্রিকান দল হিসেবে অনন্য এক রেকর্ডের মধ্য দিয়ে শেষ চারে চলে গেল মরক্কোনরা।
তবে আফ্রিকান দল হিসেবে ইতিহাসের সব সাফল্যগাঁথার ‘প্রথম’-এ নাম লেখানোর কীর্তি আগে থেকেই ছিল মরক্কোর নামের পাশে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে পয়েন্ট এসেছিল মরক্কোর সৌজন্যেই। এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল মরক্কো। আর সেটিই ছিল প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে নকআউটে অবতীর্ণ হওয়ার কীর্তি। ২০২২-এ এসে এবার তারা নিজেদের নিয়ে গেলে সেমিফাইনালে। আফ্রিকান দেশ হিসেবে প্রথম সেমিতে পৌঁছানোর কীর্তিটাও তাই আসলো মরক্কোর কারণে।
স্পেনের বিপক্ষে মরক্কোর জয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানোকে একটা কাব্য বলা যায়। পর্তুগালকে হারিয়ে সেমিতে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই একটা মহাকাব্য। মরক্কোর তাহলে পথযাত্রার পরের ধাপগুলোকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করবেন? কাব্য, মহাকাব্য ছাপিয়ে আর কিছু দিয়ে কি সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব। তবে মরক্কোর এ যাত্রা এখন আর রুপকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
এখন যা হবে তা শুধুই বাস্তবতার জানান দেওয়া, একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া গোটা ফুটবল বিশ্বের কাছে যে, পুরো বিশ্বকাপে একের পর এক জায়ান্ট দলগুলোকে হারানো কোনো ফ্লুক নয়, কিংবা অভাবনীয় ঘটনার ঘেরাটোপে অবিশ্বাস্য কোনো ইতিহাস নয়। যা হচ্ছে কিংবা সামনে হবে, তা আর শুধু রুপকথায় আটকে নেই, মরক্কোর ফুটবল সামর্থ্যের একটা অবিস্মরণীয় দৃশ্যপট এই কাতার বিশ্বকাপ।