ভয়হীন দৃঢ়চেতা মানসিকতা, বিশ্বাস আর ভরসা – অসম্ভবকে সম্ভব কিংবা অজেয়কে জয় করার জন্য এতটুকুই হয়তো যথেষ্ট। আর এটিই ফুটবল মাঠে করে দেখিয়েছে মরক্কো, বিশ্বকাপ শুরুর আগে যাদের নিয়ে বাজি ধরার একজনও ছিল না সেই দলটিই এখন জায়গা করে নিয়েছে সেমিফাইনালে। অদম্য মনোবলের জোরেই বন্ধুর এই পথ পাড়ি দিতে পেরেছে মরক্কোর ফুটবলাররা।
বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়ার সাথে একই গ্রুপে থাকায় মরক্কো শেষ ষোলোর টিকিট কাটতে পারবে সেটি নিয়েই ছিল সন্দেহ। কিন্তু সেসব অতীত হয়েছে, এখন বিশ্লেষকদের নোটবুকে বিশেষ জায়গায় রয়েছে মরক্কোর নাম। গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে সোনালী ট্রফির খুব কাছেই মরক্কো; দলটি এখন একটি দেশের স্বপ্নসারথি, একটি মহাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা আর পুরো বিশ্বের কাছে বিস্ময়।
মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগুরাগুইর কাছে এটি এক স্বপ্নীল যাত্রা, তিনি মনে করেন খেলোয়াড়দের মাঝে স্বপ্ন ছিল বলেই এমন ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছেন। স্বপ্ন আর চেষ্টার মিলনেই পেয়েছেন সাফল্য; তিনি বলেন, ‘অন্যরা আমাদের কিছু এমনিতে দিবে না। বড় দলগুলো বিশ্বকাপ নিজেদের মধ্যে রাখতে চায়।’
মরক্কোর এই অবিশ্বাস্য পথচলার নেপথ্যের কাণ্ডারি ওয়ালিদ রেগুরাগুই। অথচ তাঁর বিশ্বকাপে আসারই কথা ছিল না। কাতারে আসার মাত্র তিন মাস আগে পুরনো কোচের সাথে চুক্তি বাতিল করে রেগুরাগুইকে বেছে মরক্কোর ফুটবল ফেডারেশন এরপরই দলের মাঝে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন এই মাস্টারমাইন্ড। প্রথমেই ওইসব খেলোয়াড়দের ছেঁটে ফেলেন যাদের কাছে বিশ্বকাপ ছিল শুধুমাত্র অংশগ্রহণের মঞ্চ।
বিশ্বকাপের মঞ্চে আসার আগে মাত্র দুই ম্যাচ মরক্কোর কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ওয়ালিদ রেগুরাগুই। আর এখন সবচেয়ে দুরতম কল্পনা থেকে দুই ম্যাচ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। টুর্নামেন্টের প্রথম পাঁচ ম্যাচে যেমন খেলা উপহার দিয়েছে আফ্রিকান প্রতিনিধিরা, সেটি ধরে রাখতে পারলে এই স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দেয়া কঠিন হওয়ার কথা নয়।
এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র একটি গোল হজম করেছে মরক্কো, সেটিও প্রতিপক্ষের শট থেকে নয় বরং আত্মঘাতি গোল। দলটির ডিফেন্স লাইনের শক্তি উপলব্ধি করতে এই কথাটিই যথেষ্ট। অথচ ইতোমধ্যে বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মত বড় নামধারী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেছে দলটি।
সবমিলিয়ে মাত্র নয়টি শট অন টার্গেট হজম করেছে মরক্কো; চারটি ম্যাচেই রেখেছে ক্লিনশিট। কোচ ওয়ালিদ রেগুরাগুই অবশ্য এমন অর্জনকে অলৌকিক মানতে নারাজ। তাঁর কাছে এটি খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রম আর অনমনীয় মানসিকতার পুরস্কার। তাই তো এই কোচ বিশ্বাস করেন যেকোনো দলের জন্যই তাদের হারানো কঠিন হবে।
শুধু ডিফেন্স নয়, কাউন্টার এটাকের ক্ষেত্রেও মরক্কোর রয়েছে অবিশ্বাস্য সক্ষমতা। বিশেষ করে হাকিম জিয়েচ এর গতি, ড্রিবলিং; ইউসুফ এন নেসরির ফিনিশিংয়ে ভর করেই ছুটে চলছে ওয়ালিদ রেগুরাগুইয়ের শিষ্যরা।
এমন সফলতা অবশ্য রাতারাতি আসেনি, ফুটবল নিয়ে মরক্কো গত শতক থেকেই বেশ সচেতন। ১৯৯৪ সাল থেকেই বিশ্বকাপ আয়োজনের চেষ্টা করেছে দেশটি। এছাড়া এখানে রয়েছে আফ্রিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ফুটবল একাডেমি যা দেশটির জাতীয় দল ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলোও ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া ২০০৯ সালে মোহাম্মদ ভিআই ফুটবল একাডেমি তৈরি করা হয়েছিল, এবারের বিশ্বকাপে মরক্কোর হয়ে খেলা চার সদস্য এসেছেন এখান থেকেই।
ইতিহাস গড়েও থামতে চায় না মরক্কো, থামতে চান না কোচ ওয়ালিদ রেগুরাগুই। যেতে চান আরো দূর, এমন কিছু অর্জন করতে চান যেটি উদযাপন করতে স্বয়ং রাজাকে রাস্তায় নেমে আসতে হবে। এমন ইচ্ছের আড়ালে হয়তো বিশ্বকাপ জয়ের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন মরক্কোর কোচ; কি জানি, ভাগ্যের একটু সুদৃষ্টি পেলে সেই ইচ্ছেও পূরণ হতে পারে মরক্কোর একদল স্বপ্নবাজের।