শিল্প, যন্ত্র, ঘষেমেজে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার তাগিদে একবিংশ শতাব্দীতে রোনালদো, মেসিরা যেভাবে তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে, মদ্রিচ এগোতেই পারেনি। আজ বছর দশ পর, দীর্ঘশ্বাস ভর করে যখন বারবার মনে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য সাইনিং বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল মাঝখান থেকে সিঁথি করা প্লেয়ারটাকে। আসলে টটেনহ্যামের জার্সিটা খুব সুখকর ছিল না তো।
তার উপর চেলসির বিরুদ্ধে ওন গোলটা একটা অসূয়ার জন্মও দিয়েছিল। ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবেও অতটা আহা-উহু করার জায়গা তৈরিই হয়নি। তারপর দশটা বছর কেটে গেছে। ডাইনামো জাগ্রেবের ট্রেনিং গ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষটা শেষে নাকি সেই রিয়াল মাদ্রিদেরই নায়ক। কি জানি, কোন ফর্মুলায় বিশ্লেষণ হয় জীবনের সমীকরণগুলো।
বয়স বেড়ে গেছে। পাঁইপাঁই করে বল পায়ে কোমর দুলিয়ে মাঠ জুড়ে ছুটে চলা হাসিমুখের কাকা ছিল কৈশোরের একটা স্বপ্ন। ধীরে ধীরে বসেছে অনেক নাম, অনেক জার্সি নম্বর। নদীর জলের মত সময়ের দৌড়ে ওরা চলেও গেছে। আর তারপর এসে বসল মদ্রিচ। বসল এরিকসন। চিরকাল মিডফিল্ডারদের গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো আসনে বসিয়েছি। গোল করার থেকে করানোকে প্রাধান্য দিয়েছি।
মদ্রিচ সেই স্বপ্নের একটা ফেরিওয়ালা। চলেও যাবে লোকটা, জানি। চলে গেলে কী করব সেটা জানি না। বসে থাকব হয়তো, আবার কবে কে হেয়ারব্যান্ড পরে নামবে। যেমন লুংথুংয়ের বাচ্চা ছেলেটাকে মনে পড়ে। ‘হিঁয়া পর আচ্ছা লাগতা হ্যায়?’ এর উত্তরে বলেছিল, ‘ইয়েহি পাহাড়কো হামনে গলে লাগা লিয়া। আচ্ছা অউর বুরা, ইয়েহি ঘর হ্যায় হামারা।’ শুনে খানিক তাকিয়ে ছিলাম। সত্যিই তো, এই তো জীবন। এইটাই তো। আচ্ছা অউর বুরা, চলনা তো হ্যায় হি জনাব!
মদ্রিচের শেষ বিশ্বকাপ চলছে। একমনে দেখে যাচ্ছি একটা বছর ৩৭-এর বুড়ো খেলা। মাঠকে যে ভালোবাসে। বুড়ো ঘাসগুলোতে পা রাখলেই এক ধাক্কায় দশ বছর বয়স কমে যায়। আজ জিতবে, কাল ছিটকে যাবে। পরশু ফ্লাইট ধরবে, জাগ্রেবে গিয়ে পরিবারকে আঁকড়ে ধরবে। আর আমরা? মদ্রিচের পোস্টারের দিকে চেয়ে থাকব। যেমন করে আগের প্রজন্ম চেয়ে থাকত জিকো, ম্যারাডোনা, ম্যাথাউসের দিকে।
প্রজন্মের পর প্রজন্মে কেউ তো এরকম আসেই। যাকে মাঠে একঝলক দেখেই প্রেমে পড়া যায়। কী করব, আমরা তো স্বপ্ন যে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় সেই গলির মোড় আর ভুলতে পারি না। ‘গিভিং আপ ইস নট অ্যান অপশন’ বলে হয়তো কোনওদিন একটা বেমক্কা কথা বলে বসব!
ভাল খেলো মদ্রিচ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মারামারিতে জড়িয়ে পড়া এই অধমটার প্রেমটা শুধু তোমার জন্যই তোলা থাক। গোপন অভিসারের কথা পাড়াপড়শীকে জানাতে নেই। শুধু মদ্রিচ জানুক, ও খেলল আমার জন্যই।
চলে গেল লোকটা। ফেলে গেল পেছনে, অনেক কিছু। গৃহযুদ্ধের ইতিহাস, দিনেমো জাগ্রেবের সেই দিনগুলো, ঘরহারা অসহায়তা, টটেনহ্যাম থেকে মাদ্রিদের বাজে সাইনিং… সব সব। শেষ অব্দি মাঠেও থাকল না। লিভাকোভিচের চোখ বন্ধ করা প্রার্থনা শুনল না কেউ। মদ্রিচের নাকে সজোরে বল লাগলে কেউ এল না পিঠে হাত রাখতে। হাল ছেড়ো না— কই, কেউ তো বলল না। আর কেউ বলবেও না। বলার কারণগুলো একে একে ব্যাগের ভিতর চুপিসাড়ে ঢুকে পড়ল।
ঐ যে, চলে যাচ্ছে মদ্রিচ। আর ফিরবে না এ সবুজ মাঠে। একটা লাল-সাদা জার্সিতে এই বয়সে একটা করে ফাইনাল-সেমিফাইনাল খেলে নিয়েছে। গোল্ডেন বল, ব্যালঁ ডি অর পেয়েছে। আবার বিশ্বকাপ? মদ্রিচ তো ঈশ্বর নয়। নশ্বর দেহর খুব বেশি চাওয়া থাকতে নেই।
মধ্যবিত্তদের মত এরিনা ছেড়ে যাওয়ার আগে একবার আউট স্টেপে বলে দিতে হয়, আমি ছিলাম। এখানেই, একদিন ছিলাম। মদ্রিচ চলে যাচ্ছে মাঠ থেকে। এবার গল্পের বইটা যথাস্থানে তুলে রাখার দিন।