অজস্র প্রশ্ন, মেসি-ম্যারাডোনা আর ফরাসি বিপ্লব

‘আফটার দ্য গেম ইজ বিফোর দ্য গেম’

ফুটবলের প্রথমদিককার দার্শনিক সেপ হারবার্গার একবার কথাটি বলেছিলেন। এটির ভাবানুবাদ অনেকটা এমন যে, একটি ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার পরপরই পরবর্তী ম্যাচে মনোযোগ দিতে হয়। বহু পুরনো এই উক্তিটি আশ্চর্যজনকভাবেই অনুসরণ করে চলেছে কাতার বিশ্বকাপ খেলতে আসা আর্জেন্টিনা।

আর্জেন্টিনার উদ্বোধনী ম্যাচের কথা মনে আছে? টানা ৩৬ ম্যাচ ধরে জিততে থাকা দলটি বিশ্ব মঞ্চে প্রথম ম্যাচেই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল, র‍্যাংকিংয়ে বহুদূরে থাকা সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে বসে তারা। অন্য কোন গড়পড়তা দল হলে হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে গুড়িয়ে যেতো। কিন্তু সেপ হারবার্গারের দর্শন অনুসারীরা হারের ক্ষতের দিকে না থাকিয়ে নজর দিয়েছে পরের ম্যাচে, আর তাতেই মিলেছে সাফল্য।

আর্জেন্টিনার আকাশে জমা ঘন কালো মেঘ সরে উঁকি দিয়েছে সোনালী সূর্য। পা হড়কালেই বিশ্বকাপ থেকে বাদ এমন সমীকরণ মাথায় রেখেই খেলেছিল গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচ; নক আউট পর্বে অস্ট্রেলিয়ার পর নেদারল্যান্ডসের মত ফেভারিট আর জায়ান্ট কিলার ক্রোয়েশিয়ার মত দলের মুখোমুখি হয়েছিল কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু কোন কিছুই আর থামাতে পারেনি তাদের; লিওনেল মেসি, জুলিয়ান আলভারেজদের ডানায় ভর করে ফাইনালে উঠে এসেছে লাতিন আমেরিকার দেশটি।

আরেক ফাইনালিস্ট ফ্রান্সের গল্পটা ভিন্ন হলেও একটা বিন্দুতে মিলে যায় আর্জেন্টিনার সাথে। তিক্ত পরাজয় নয়, ফরাসিদের প্রথম প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইনজুরি। ইনফর্ম স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা ছাড়াও বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বে ছিটকে গিয়েছিলেন পল পগবা, এনগোলো কান্তে, প্রেসনেল কিম্বেপে, এনকুকুর মতো তারকা খেলোয়াড়রা৷ তবে কোচ আর অন্য খেলেয়াড়দের দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা এবং দারুণ পারফরম্যান্সের কারণে বাজিমাত করেছে ফ্রান্স।

বিশ্বকাপ জিতে লিওনেল মেসিকে ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে যাবেন? বিশ্বকাপ না জিতলে ফুটবলীয় সাম্রাজ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে অমরত্ব দিতে পারবেন মেসি? মেসি নিজে আসলে কি চান? নাকি পেলের পর সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার হিসেবে টানা দুইটি বিশ্বকাপ জিতবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে? ইতালি ও ব্রাজিলের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে শিরোপা ধরতে রাখতে পারবে ফরাসিরা? – আকাশে বাতাসে ভাসছে কত কত প্রশ্ন।

সুপার সানডে এর সুপার ক্ল্যাশ নিয়ে ভক্তদের উন্মাদনা আর আলোচনার কোন কমতি নেই। ইতোমধ্যে লিওনেল মেসির অফিশিয়াল জার্সির চাহিদা সরবরাহ সীমা অতিক্রম করেছে; বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিটের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতেও রাজি অনেকে।

এতকিছুর পরেও ডিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে লিওনেল মেসির তুলনায় যেতে আগ্রহী নন অধিকাংশ আর্জেন্টাইন ভক্ত-সমর্থকেরা। বিশেষ করা যারা ম্যারাডোনিসমো হৃদয়ে ধারন করতে পেরেছেন তাদের কাছে এই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির স্থান সবার উপরে। আর্জেন্টিনার সাবেক ডিফেন্ডার হ্যাভিয়ের জানেত্তি মনে করেন, ‘এই বিশ্বকাপের ফলাফল মেসি-ম্যারাডোনা দ্বৈরথে কোন প্রভাব ফেলবে না। মেসি সবসময়ই ম্যারাডোনার সাথে একই কাতারে থাকবেন।’

২০০৬ সালে লিওনেল মেসির সতীর্থ ছিলেন ম্যাক্সি রদ্রিগেজ। তিনি জানান যে, ‘সময়ের সাথে মেসির নেতৃত্বগুণ আরো দারুণ হয়ে উঠেছে। তাঁর অর্জন, অভিজ্ঞতা, পারফরম্যান্স সবকিছু দলের বাকিদের অনুপ্রাণিত করে। সে যখন থাকবে না তখন নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনা দল তাঁকে মিস করবে।’

অনেক সময় ধরে লিওনেল মেসির সাথে জাতীয় দলের ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করা পাবলো জাবালেতা বলেন, ‘সে (মেসি) জানে এটা তাঁর সুযোগ, তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। সবসময়ই সেরাদের কাতারে থাকা মেসি এখন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আদর্শ। জয়ের পথে হাঁটার জন্য, সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মেসি একজন শিক্ষকের মতই।’

অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার অপেক্ষা এখন, চারপাশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কাতারের দোহা স্টেডিয়ামে হতে পারে অনেক কিছু। হৃদয় ভাঙ্গতে পারে যে কারো; কারো মুখে দেখা যাবে চওড়া হাসি। তবে যে-ই জিতুক, দিনশেষে ফুটবল জিতলেই জিতে যাবে ফুটবলপ্রেমীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link