আর্জেন্টিনার থেকে বড় অপেক্ষমান আর কেউ নেই

ব্রাজিল পারল না যখন, তারপর থেকে বিশ্বকাপের জৌলুস অন্তত আমার কাছে কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে গেল। আসলে চার বছর অন্তর এই এক একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা, পরীক্ষা-নিরিক্ষার পরে নিজের সবচেয়ে প্রিয় দলকে চোখের জলে এরিনা ছাড়তে দেখলে কারই বা ভাল লাগে! কিন্তু মেনে নিতে হয়।

অন্য দলকে ছোট-বড় করার লড়াইয়ে না নেমে যাদের কাছে হেরেছি, তাদেরকে সামনের জার্নির জন্য কনগ্র্যাচুলেট করে নিজেদের করা ভুল থেকেই শিক্ষা নিতে হয়। আর তাকিয়ে থাকতে হয় আগামী জার্নিগুলোতে কে কেমন খেলে, কে কতদূর যায়, কীভাবে যায়।

এই আর্জেন্টিনা শুরুতে বিপক্ষের চালে ম্যাচ খুইয়েছিল। স্কালোনি রেনার্ডের চালকে ধরতে না পেরে আনফিট রোমেরোকে নামায়। যার রিফ্লেকশন টাইম কম হওয়াতে দুটো গোল, গোলে এমি মার্টিনেজের হাত থাকতেও। তারপর যত সময় এগিয়েছে, সাবজেক্ট ওয়াইস পরীক্ষার প্রস্তুতির মত ম্যাচ বাই ম্যাচ অপোনেন্ট অ্যানালিসিস করে করে স্ক্যালোনি এগিয়েছে।

লাউতারো মার্টিনেজ ৩-৫-২ তে সেকেন্ড স্ট্রাইকারে ফিট কিন্তু মেসিকে ছাড়া চলবে না ঐ পজিশনে। তাই লাউটারো আউট, আলভারেজ ইন। যে গোল চেনে, স্ট্রাইকার পিভটের কাজ করবে, দরকারে মেসিকে আপে তুলে নিজে ডানে সরবে। কয়েকগুলো স্ট্রিং জুড়ে দলটাকে টেনে ওপরে তুললেন মেসি। এই সেই মেসি, যে নাকি আর পাঁইপাঁই করে মাঠের মাঝখান থেকে দৌড়ায় না।

ক্রোয়েশিয়ার সেন্টার ব্যাক গ্যাভারদিওল নিজের কেরিয়ারের শুরুর বিশ্বকাপেই বেস্ট ডিফেন্ডার। তাকে ১০ গজ দৌড়ে বক্সের কাছে এনে একটা বডি ফেন্টে শরীর ডানে দুলিয়ে বাঁয়ে রান করল। যেখানে আলভারেজকে কেউ এক্সপেক্ট করেনি এমন জায়গা খুঁজে বলটা প্লেস করল।

আজকেই দেখলাম এক জায়গায়, এই আর্জেন্টিনা আজ না জিতলে হোমারের ট্র্যাজেডির মত ব্যাপার হবে। খানিকটা তাই।

গাঁয়ের সবাই যখন ভগবান বন্দনায়, তখন আমি নিচের ছবিটার দিকে তাকাই। মারাদোনা, মেসি, স্কালোনি আর রিকেলমে। যাদের একজন ফকল্যাণ্ড যুদ্ধের বদলা নিতে একবার পাপ, একবার পুণ্য করল। যাদের একজন সারাজীবন আক্ষেপের বোঝা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ালো আর অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে স্নেহচুম্বন এঁকে দেওয়া সেই পেকারম্যানের ভুলে কখনও সোনালী ট্রফিটার কাছে পর্যন্ত যেতে পারল না।

একজন দেপোর্তিভোতে থাকাকালীন স্প্যানিশ কাপে সেরা সময়ের মাদ্রিদকে হারিয়ে কাপ তুলেছে। অপ্রীতিকর হোর্হে সাম্পাওলির অতিকথনের পাশে চুপ করে ম্যাচ রিড করে গেছে। আর একজন, যার দিকে আজ গোটা আর্জেন্টিনা তাকিয়ে। ২০১৪-র মত। ২০১৫, ২০১৬-র মতো। ২০২১-র মত আনন্দের জন্য। সেই লিওনেল, যার জন্য রোজারিও থেকে বুয়েনার্স আয়ার্সের নি:শ্বাস আটকে যাচ্ছে।

আজকের পর কী হবে তা উপরওয়ালা মালুম। স্কালোনি কী চাল চালবেন, তার পাল্টা কী ভেবে রেখেছেন দেশঁ কেউ জানে না। শুধু ফ্রান্স এটুকু জানে দেশঁর একটা ভুল জিদানের পথ পরিস্কার করবে।এমবাপ্পে না খেলতে পারলে আবার অপেক্ষা, জিরুর এই ফর্মে ফিরে আসার পরিসমাপ্তিটা ভাল হবে না এবং সারাজীবন একজন আন্ডাররেটেড নাম্বার নাইন হয়েই থেকে যাবে। গ্রিজম্যানের ট্র্যাকব্যাকিংয়ের অর্থ অনর্থে পরিণত হবে। আরও অনেক, অনেক কিছু।

আর আর্জেন্টিনা জানে এই উপন্যাসের শেষে হার লেখা থাকলে সেটা নাও অর নেভারে রূপান্তরিত হবে। ম্যারাডোনার পাশে মেসি নয়, বরং আবার একটা হারের যন্ত্রণা বুকে বয়ে ছুটতে হবে দেশ থেকে দেশান্তরে।

আবার খোঁচা আসবে, আবার তারা পালিয়ে বেড়াবে জনমানসের থেকে দূরে। সেই রিকেলমের মত, সেই ভেরন, ওয়াল্টার স্যামুয়েলের মত। তরুণ মেসির ড্রিবলিং দেখবে ইউটিউব চালিয়ে। একটা হার, আবার একটা হারের গল্পের পাতা ওল্টাবে।

ডানদিকে নিচে মারাদোনার পাশে বসে থাকা লম্বা চুলের প্রতিভাবান আজ দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলতে নামছে কাতারের মাঠে। এই শেষবার। আর নয়, আর কোনওদিনও নয়। এই শেষবার হয়তো লাতিন ঘরানার সাবেক ড্রিবলিং, বলকে চাবুক মেরে নিজের কথা শোনানোর সে সংস্কৃতিকে নিজের পায়ে নিয়ে নামবে আর্জেন্টিনা।

দেশ্যমের থেকে বড় ম্যাচ রিডার আর কেউ নেই, আর্জেন্টিনার থেকে বড় অপেক্ষমান আর কেউ নেই। একটুর জন্য অনেকবার অনেক কিছু শেষ হয়ে গেছে। আজ যেন না হয়। শিল্ড যেন লাতিন গাঁয়ের বাইরে না যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link