রহস্য-রোমাঞ্চ, উত্থান-পতন: এটাই বিশ্বকাপ ফাইনাল!

৩৬ বছরের বিশ্বকাপ খরা কাটিয়ে আবারো বিশ্বকাপ গেলো আলবিসেলেস্তাদের দূর্গে। মারিও কেম্পেস, ডিয়েগো ম্যারাডোনার রেখে যাওয়া পথে এবার হাঁটলেন লিওনেল মেসি। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম থেকে বুয়েন্স আয়ার্স-পুরো আকাশটাই যেন আজ আর্জেন্টিনাময়। তবে আরাধ্য সেই ট্রফি ছোঁয়ার পথে কম নাটকীয়তা হয়নি। বিশ্বকাপের তথাকথিত ফাইনাল ম্যাচের রোমাঞ্চ ছাড়িয়ে পুরো ম্যাচটাই রূপ নিয়েছিল গা কাঁটা দেওয়ার মতো এক থ্রিলারে।

স্নায়ুতে আলোড়ন, সাথে সাসপেন্স আর সাসপেন্স, ঠিক যেন পেণ্ডুলামের মতো দুলছিল ম্যাচটা। কী ছিল না এই ম্যাচে! ৬ টা গোল, একটি হ্যাটট্রিক, তারপরও ম্যাচে কোনো ফল মেলেনি। তাই শেষ পর্যন্ত গোটা বিশ্বকে চোখ রাখতে হয়েছিল পেনাল্টি শ্যুটআউটের দিকে। আর সেই অন্তিম মহাযজ্ঞে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ বীরত্বে শেষ হাসিটা হেসেছে আর্জেন্টিনা।

ঐতিহাসিক এমন ফাইনালের সারকথা ঠিক এতটুকুতেই জমে না। কতশত মুহূর্তের মঞ্চায়ন হয়েছে এই এক ম্যাচেই। সে সব কাব্যগুলোকে ঘিরেই সালতামামিতে বন্দী করে ফাইনাল ম্যাচটা আরেকবার নাহয় ফিরে দেখা যাক।

নব্বই মিনিটের ম্যাচে ৭৭ মিনিট পর্যন্ত আর্জেন্টিনারই প্রতাপ দেখছিল বিশ্ব। ম্যাচের ২৩ মিনিটে ডি মারিয়া একটি পেনাল্টি আদায় করে নেন। স্পটকিক থেকে গোল করতে ভুল করেননি লিওনেল মেসি। আর এতেই দারুণ এক রেকর্ডে নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেন মেসি। এ বারের বিশ্বকাপের নক আউট পর্বের সব ম্যাচেই গোল করার কীর্তি গড়েন তিনি। যা এর আগে আর কারো ছিল না।

প্রথম গোলের পরে আরো গোছালো আর্জেন্টিনা। মেসি, ডি মারিয়াদের আক্রমণের ধার বাড়ায় ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডাররা রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। আর সেই সুযোগে আরো একটি গোল করে বসে আর্জেন্টিনা। মেসির দারুণ এক টাচে ম্যাক অ্যালিস্টার ক্রস করে বল বাড়িয়ে দেন ডি মারিয়ার দিকে। আর সেই বাড়ানো বল থেকে দারুণ এক ফিনিশিংয়ে গোল করেন তিনি। এ নিয়ে আর্জেন্টিনার শেষ তিন শিরোপা যাত্রার প্রত্যেকটির ফাইনালেই তিনি গোল করার কীর্তি গড়লেন।

২-০ ব্যবধানে বেশ নির্ভার থেকেই প্রথমার্ধ শেষ করে আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও নিজেদের ছন্দ ধরে রেখেছিল তারা। তবে ম্যাচের সব কিছু পাল্টে যায় ৮০ তম মিনিটে। হঠাতই এক ঝড়ে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন এক মুহূর্তের জন্য লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

ম্যাচের ৮০ মিনিটে ডি-বক্সে ওটামেন্ডির করা ফাউলের কারণে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। স্পটকিক থেকে গোল করতে ভুল করেননি এমবাপ্পে। একটি গোল শোধ করে ফ্রান্স। আর সেখানেই যেন ম্যাচের মোমেন্টাম নিজেদের দিকে নিয়ে নেয় ফ্রান্স।

এর ঠিক মিনিট দেড়েক পড়েই আবারো গোল করেন এমবাপ্পে। দারুণ এক ভলিতে গোল করে আর্জেন্টিনার আগাম জয়োৎসবের মাঝে জল ঢেলে দেন তিনি। আর এর কিছুক্ষণ বাদে, ম্যাচের ৯০ মিনিট ২-২ গোলে সমতায় থেকে শেষ হয়।

অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা। আর্জেন্টিনার দেওয়া দুই গোল শোধ করে এরই মধ্যে ফ্রান্স খেলায় বেশ ভালভাবে ফিরে আসে। তাই আর্জেন্টিনার শিবিরে কিছুটা দমে যাওয়ার মতোই উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছিল তখন। কিন্তু ম্যাচের ১০৮ মিনিটে ত্রাতা রূপে হাজির হন স্বয়ং মেসি।

লাউতারো মার্টিনেজের বাড়ানো বল থেকে ফ্রান্স গোলবারের লাইন অতিক্রম করে গোল করেন তিনি। আর এই গোলের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপের গোলসংখ্যায় পেলেকে(১২) ছাড়িয়ে যান তিনি(১৩)। একই বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১ টি গোলে কন্ট্রিবিউশন নতুন এক কীর্তি গড়েন লিও মেসি।

কিন্তু ম্যাচ তখনো শেষ হয়নি। মেসির জন্য মঞ্চটা তখনো পূর্ণতা পায়নি। আর সেই পথে মেসির দিকে বেয়ে আসা আলো আবার কেড়ে নেন এমবাপ্পে। ম্যাচের ১১৮ মিনিটে আবারো পেনাল্টি ফ্রান্স। আর সেখান থেকে গোল করে হ্যাটট্রিক করেন এমবাপ্পে।

এর মধ্য দিয়ে দুটি রেকর্ড গড়ে ফেলেন সাথে সাথে। ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি গড়েন তিনি। আর বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডেও নিজের নাম লেখান তিনি। আগের বিশ্বকাপ ফাইনালে ১ গোল, আর এবারের বিশ্বকাপে ৩ গোল। বিশ্বকাপের ফাইনালে এমবাপ্পে ছাড়া ৪ গোল করার কীর্তি আর কারো নেই।

এমবাপ্পের ঐ গোলের পরেই ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। তবে ম্যাচের একদম শেষ মিনিটে দারুণ এক সুযোগ পেয়েছিল ফ্রান্স। কিন্তু গোলবারের সামনে রীতিমত ঢাল হয়ে সে যাত্রায় আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে দেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।

পেনাল্টি শ্যুটআউটে খেলা গড়ালে প্রথমে শ্যুট করতে আসেন এমবাপ্পে। গোল করতে একটুও ভুল করেননি তিনি। ফ্রান্স এগিয়ে যায় ১-০ তে। তবে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম শট নিতে এসে গোল করে সমতায় আনেন মেসি। হয়তো সেখান থেকেই আরো দুর্দান্ত হয়ে ওঠেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।

ফ্রান্সের পরের দুটি শটই তিনি ঠেকিয়ে দেন। যার ফলে, আর্জেন্টিনাও চলে যায় বিশ্বকাপের হাত ছোঁয়া দূরত্বে। তবে মার্টিনেজের সেভের সাথে আর্জেন্টাইন পেনাল্টি টেকারদেরও দায়িত্ব নিতে হতো সমানভাবে। আর সেই কাজটা দিবালা, পারেদেস, মন্টিয়েলরাও ভাল ভাবেই করেছেন।

প্রত্যেকেই নিজের শটে গোলের নিশানা ভেদ করতে পেরেছেন। আর এখানেই ফাইনালের সব নাটকীয়তা শেষে ম্যাচটি নিজেদের করে নেয় আলবি সেলেস্তারা। রোমাঞ্চের ষোলকলা পূর্ণ করে বিশ্বকাপটি জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।

৩৬ বছরের বিশ্বকাপ খরা, মেসির শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা লাতিন আমেরিকার ঘরে আবারো বিশ্বকাপ যাওয়া- সবকিছুরই দৃশ্যায়ন হয় মন্টিয়েলের শেষ পেনাল্টির পর। মেসি তাঁর আরাধ্য ট্রফির ছোঁয়া পান,  একই সাথে আর্জেন্টিনাকেও করেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম তাই সাক্ষী হয় ঐতিহাসিক এক মুহূর্তের।

৩৬ বছর আগে ম্যারাডোনা যেভাবে ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন, ঠিক অবিকল ভাবে মেসিও সেই উদযাপনটা ফিরিয়ে আনলেন। মেসিকে কাঁধে নিয়ে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করলেন সাবেক সতীর্থ, বন্ধু সার্জিও আগুয়েরো। ঠিক যেন ম্যারাডোনার মতোই।

দুটি ভিন্ন ছবি, কিন্তু উপলক্ষ্য এক, সাদৃশ্যতায় ঘেরা দুই কিংবদন্তির একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্যমণি হওয়ার দৃশ্যটাও প্রায় এক। একেই বলেন, ইতিহাস কারো না কারো মাঝ দিয়েই ফিরে আসে। এবার সেই দৃশ্য ফিরেছে মেসির মাধ্যমে। বিশ্বকাপ জয়ের পর মেসি হয়তো ম্যারাডোনার পাশে দাঁড়ালেন একই কাতারে। কিন্তু মেসিকে এখন আর ম্যারাডোনা হতে হবে না। কারণ এখনকার মেসি, মেসিই।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link