শ্বাসরুদ্ধতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী

মোদ্দা কথাটা হল, ১৯৮২ থেকে ফাইনাল দেখছি, ৮৬টা ছাড়া এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর হয়নি। ’৯৪ আর ’০৬-এও শেষের দিকে বোরিং হয়ে গিয়েছিল। ’১৮-তে ক্রোয়েশিয়া জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ফ্রান্সের কোয়ালিটির কাছে হেরে যায়।

২০২২-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল আমার দেখা তো বটেই, হয়তো সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল। আমি ১৯৬৬, ১৯৭৪, ১৯৫৪, ১৯৫০ এবং ১৯৩০ দেখিনি, দেখার কথা নয়। তবে যেটুকু পড়াশুনো রয়েছে তাতেও হয়তো ২০২২-এর নাটকটা সর্বকালেরই সেরা।

সে যাক, বিশ্বকাপ ফাইনালের ঠিক দিন তিন চার আগে ফ্রান্সের প্রথম দলের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাইরাল। র‍্যাবিয়ঁ আর উপমেকানো তো সেমিফাইনালই খেলতে পারেননি। বাকি নামগুলো হল কোমান, ভারান, কোনাতে, চৌমেনি, হার্নান্ডেজ। কোচ দেশঁ অভিযোগ করেন যে এয়ারকন্ডিশনড স্টেডিয়ামে খেলতে গিয়েই নাকি এই বিপত্তি।

সে যাক, আসল কথা হল কোনাতে ছাড়া সকলেই ফাইনাল খেলার জন্য ‘আপাত’ সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ তো? দেড় দু সপ্তাহ আগেই নেয়মার যখন সুস্থ হচ্ছেন তখন এই পয়েন্টটা উঠেছিল যে আঘাত তো সেরে গেছে, কিন্তু ভাইরাল থেকে সুস্থ হতে এবং সামগ্রিক রিকভারিতে সময় লাগছে। ফাইনালে প্রথমার্ধে ফ্রান্সের নড়াচড়া দেখে কিন্তু কিছুটা হলেও তাই মনে হয়েছে। ধন্যবাদ সৌভাগ্যকে এই পয়েন্টটা মনে করিয়ে দেবার জন্য।

লিও স্কালোনি। আর্জেন্টিনার ২০১৯এ দায়িত্ব পাওয়ার আগে স্কালোনির সিনিয়র দলকে পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা ছিল শূন্য। শুরুতে তাই ভারপ্রাপ্তই ছিলেন, কিন্তু কোপা, বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং এবং ফ্রেন্ডলির পারফরম্যান্স তাঁকে নিয়মিত প্রশিক্ষক করে দিতে সাহায্য করে। এই নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে যে লিও মেসিকে অপ্টিমাম ব্যবহার করতে স্কালোনি একটা খুব সুন্দর ফ্লেক্সিবল সিস্টেম তৈরি করেছেন। তাই ওই রাস্তায় আর যাচ্ছি না।

কালকের কথায় চলে যাই। ফ্রান্স শিবিরের অসুস্থতার কথা স্কালোনি মাথায় রেখেছিলেন। তাই শুরুতে দলে অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া। দি মারিয়া আজ থেকে পাঁচ ছ’বছর আগেও স্টার ছিলেন, এখনও আছেন। তবে এখন দমে ঘাটতি পড়তে শুরু করেছে। সেভাবে ট্র্যাকব্যাক করতে পারেন না। মোটামুটি ৪৫-৬০ মিনিটের খেলোয়াড়। কিন্তু দ্রুতগতিতে ড্রিবল এখনও করতে পারেন, আর একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতে এখনও ভরসাযোগ্য।

আর্জেন্টিনা শুরু তো করেছিল ৪-৩-৩এ কিন্তু আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিল ২-২-৬এ পৌঁছে যাওয়া। আকুনাকে রেখে দেওয়া হয়েছিল যখন দি মারিয়া উঠে যাবেন তখনকার জন্য। আর টাগলেফিকোর সাপোর্টিং প্লে আকুনার থেকে বেটার। (এটা যদিও আমি আগে থেকে প্রেডিক্ট করতে পারিনি)

স্কালোনি দি মারিয়াকে বাঁদিকে রেখে চালটা দিলেন বটে তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডানদিকের ওভারলোড। মলিনা উঠছেন, দি পল হাফস্পেসে, মেসি রয়েছেন, ম্যাকঅ্যালিস্টার ফ্লোট করে আসছেন ডানদিকে আর আলভারেজ ফ্লোটার ফলস ৯। এতে দেশঁর দল একটু সমস্যায় পড়তে শুরু করল। থিওকে রক্ষণে সাহায্য করার জন্য র‍্যাবিয়ঁ নিজেকে রাখলেন বামকেন্দ্রে, মাঝখানটা দিয়ে আলভারেজ ঢুকে পড়তে পারেন, তাই চৌমেনি এদিকে সরে এলেন, লিও মেসির পায়ে বল মানেই অতিরিক্ত চাপ ফলত গ্রিজমানকেও দায়িত্ব দেওয়া হল, রাইট ওভারলোড করার। এইখানেই, মজাটা হল, দি মারিয়া বারবার কুন্ডেকে একের বিরুদ্ধে একে পেয়ে যাচ্ছিলেন।

সঙ্গে ম্যাকঅ্যালিস্টার প্রয়োজনে ওয়াল খেলার জন্য পৌঁছে যাচ্ছেন, ফলে কুন্ডেকে সাহায্য করার জন্য ডেম্বেলেকে নেমে আসতে হচ্ছিল। টাগলেফিকোও পৌঁছে যাচ্ছেন উপরে। এরকমই একটা পরিস্থিতিতে ম্যাকঅ্যালিস্টার কুন্ডেকে টেনে নিলেন পেনাল্টি বক্সের মাথায় আর ডেম্বেলেকে টেনে এনে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ফাউলটা নিলেন দি মারিয়া। ডেম্বেলের ডিফেন্সিভ ক্ষমতা বেশ ভালো হলেও, এ ক্ষেত্রে যখন অ্যাটাকার পেরিয়ে যায়, তখন পায়ে পায়ে ছুটতে নেই সেটা মনে ছিল না। কুন্ডে কিন্তু ঠিক একই পরিস্থিতিতে এর কিছু পরে দি মারিয়াকে মাইনাস করতে দিলেন।

দ্বিতীয় গোলটার ক্ষেত্রে আবার সেই ডানদিকের ওভারলোড, এবারে ডানদিকে আলভারেজ, মাঝখানে ম্যাকঅ্যালিস্টার। আসলে যেটাতে স্কালোনি নজর দিয়েছিলেন সেটা হল দ্রুত টার্নওভার। এঞ্জো এই জায়গাটায় দুর্দান্ত, ডিফেন্স থেকে দ্রুত বল বার করে এনে দি পল-মেসি পাসিং চ্যানেলে পাঠানোটা ভীষণ দ্রুত হচ্ছিল। জিরুকে নেমে আসতে হচ্ছে এঞ্জো ফার্নান্ডেজকে ধরার জন্য, তাই বারবার এম্ব্যাপের জন্য একের বিরুদ্ধে দুই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।

দেশঁ দ্রুত ব্যাপারটা ধরতে পারলেন এবং পরিবর্তন করলেন, কিন্তু ততক্ষণে ২-০ হয়ে গিয়েছে। ৪৫ হবার আগেই জিরু আর ডেম্বেলেকে তুলে আরও বেশি মোবাইল থুরাম এবং কোলোমুয়ানিকে নামালেন। উদ্দেশ্য এমব্যাপেকে মাঝখানে নিয়ে ওটামেন্ডির শ্লথতার ফায়দা ওঠানো।

কিন্তু তখনও কাজ হচ্ছে না। দি মারিয়ার ৬০ মিনিট এবং কাজ ফুরিয়ে গেলে আকুনা নামলেন। কিন্তু আসল সমস্যাটা শুরু হয়েছে আর্জেন্টিনার ডানদিকে। মলিনা এতক্ষণ ধরে ওঠা নামা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, এই জায়গাটা এক্সপ্লয়েট করা শুরু হল।

৭০ মিনিটের মাথায় গ্রিজমান উঠে কামাভিঙ্গা নামলেন। যিনি থিওর জায়গায় নিজেকে নিয়ে এলেন আর থিওর জায়গায় নামলেন কোমান। ফ্রান্স চলে গেল ৩-৩-৪এ। বাঁদিকে থুরাম আছেনই কিন্তু এম্ব্যাপে নিজেকে ইনভার্টেড লেফট উইং-এ রাখলেন। কোলো মুয়ানি স্ট্রাইকার হিসাবে ডানদিক ঘেঁসে আর কিংসলে কোমান নিজের কাজ শুরু করলেন ডান উইং-এ।

এতক্ষণ যে কিলিয়ানের বিরুদ্ধে ১-এর বিরুদ্ধে ২ পরিস্থিতি শুরু হচ্ছিল, সেটা নড়ে গেল। রোমেরো ওটামেন্ডির থেকে সামান্য লম্বা বলে কোলোমুয়ানিকে ধরতে শুরু করলেন আর প্রথম সুযোগেই ওটামেন্ডি একটা ভীষণ ভুলভাল কাজ করলেন, থুরামকে ফেলে দিলেন, গতিতে পরাস্ত হয়ে। কড়া রেফারি হলে হয় তো লালকার্ড দেখতেন কারণ ওটামেন্ডি লাস্ট ডিফেন্ডার ছিলেন।

কিলিয়ান এতক্ষণ ধরে সুযোগ পাচ্ছিলেন না বিশেষ। এবারে গোল পেয়ে দৈবতাড়িতর মতো খেলতে শুরু করলেন। থুরামের সঙ্গে একটা ওয়াল খেলে টেকনিকালি ব্রিলিয়ান্ট শট নিলেন, এমি মার্তিনেজের খুব বেশি দূর দিয়ে যায়নি, কিন্তু গতি অপ্রতিরোধ্য ছিল। শেষ দশ মিনিট ফ্রান্সের ৩-৩-৪এর চাপে নাভিশ্বাস উঠে গেছিল আর্জেন্টিনা ডিফেন্সের।

এখানে আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করলেন স্কালোনি, যতই আঘাত থেকে ফিরে আসা হোক, বা গোলের মধ্যে না থাকা হোক, লাউতারোর হোল্ড আপ প্লে এখনও বিশ্বমানের। গোলটার ক্ষেত্রে এঞ্জো ডানদিকে থেকে মাইনাস করলে লাউতারোর শট ফিস্ট করলেন লরিস। মেসি মরিয়া, উপমেকানোর পাগলপারা ডিফেন্ডিংও বাঁচাতে পারল না। ৩-২।

সবাই ধরে নিয়েছে ম্যাচ পকেটে। কিন্তু কিলিয়ান ছাড়তে পারে? এই দিক থেকে কিলিয়ান একদম ক্রিশ্চিয়ানোর মতো, স্বাভিমান, আত্মসম্মান, ইগো। কিলিয়ানের ইগো মরার আগে মরতে দিল না। মলিনার বদলি মন্টিয়েলের ঝুলে থাকা হাত, খেলা শেষের চার মিনিট আগে আরেকটা লাইফ লাইন দিল। কিলিয়ান তখন রক্তস্নাত যোদ্ধা। যাকে হাতে পাচ্ছেন কাটছেন।

১২০ মিনিট শেষ। এবারে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমনিতে টাইব্রেকারে যেকোনোও কিছু হতে পারে। কিন্তু লরিস তাঁর পূর্বসূরি ফ্যাবিয়ান বার্থেজের ট্র্যাডিশন ধরে রাখবেন আশা বা আশঙ্কা করা গেছিল। বার্থেজ ২০০৬এর ফাইনালের পেনাল্টি শ্যুটআউটে একটা বলও ঠিক দিকে ঝাঁপাননি। লরিসও যদিও বা ঠিক দিকে ঝাঁপালেন, কিন্তু একটি বারেও মনে হয়নি যে বাঁচাতে পারবেন। অপরদিকে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। মার্তিনেজ আধুনিক গোলকিপারের মতো নিচ থেকে খেলা তৈরি করতে দড় নন, সুইপার গোলকিপিংও পারেন না তেমন। কিন্তু নকআউটের ক্ষেত্রে যে জিনিসটা বড় ব্যাপার সেই একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতি এবং পেনাল্টির ক্ষেত্রে বিশ্বমানের। ব্যাস ট্রফি চলে এল।

এই ফাইনালের ম্যান অব দি ম্যাচ কিলিয়ান এমব্যাপে ছাড়া কাউকে ভাবা সম্ভব নয়। অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া খুব ক্লোজ সেকেন্ড হতে পারেন আর কি। কিন্তু আত্মমর্যাদা একজন খেলোয়াড়কে কতটা তাড়িয়ে বেড়ায় তার উদাহরণ কিলিয়ান। এক্ষেত্রে আবার বলছি তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি।

আর লিও মেসি? লিও মেসির কেরিয়ারটা দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার মতো লড়াইয়ের নয়। লা মাসিয়া তাঁকে স্পট করার পর থেকেই সকলেই জানেন যে তিনি বিশ্ব সেরা হতে চলেছেন। কিন্তু প্রতিভা এবং পূর্ণতার মধ্যে অনেকটা দূরত্ব। সেটা বছরের পর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রস্তুতি এবং একাগ্রতা দিয়ে তিনি পূরণ করে চলেছেন। এভাবে সত্যিই হয় না, একটা কাপ পাওয়া শুধুমাত্র একজনের জন্যই। কিন্তু গত কোপা থেকেই যেভাবে একের পর এক টুর্নামেন্টে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে একটা মাঝারিমানের দলকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

দিদিয়ের দেশঁর কথা আগেও বলেছি। নক আউট টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সেরা পাঁচজনকে হারিয়েও, অসুস্থতা থেকে ফিরে আসা পাঁচজনকে নিয়েও প্রথম অর্ধে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েও কীভাবে ফিরে আসা যায় সেটা দেশঁর কাছ থেকে শিখতে হয়।

কিন্তু এই জয়ের নায়ক একজনই। লিও স্কালোনির কোনও আভিজাত্য নেই, তাই জাত্যাভিমানও নেই। প্রথম ম্যাচে হারের পর তাই তিনি দ্রুত ভুল শুধরে এঞ্জো ফার্নান্ডেজকে ম্যাচ টাইম নিয়মিত দিতে কার্পণ্য বোধ করেননি। আনকোরা আলভারেজকেও।

ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বাঁদিকে উইডথ দেবার জন্য দিমারিয়াকে খেলিয়ে দেওয়া এবং ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি বেটার বলে সফল আকুনার জায়গায় টাগলেফিকোকে খেলানো মাস্টারস্ট্রোক। আর লে সোলসোর বদলি হিসাবে ম্যাক অ্যালিস্টারকে তৈরি করে ফেলাও। কিন্তু সবথেকে বড় মাস্টারস্ট্রোক বোধহয় বয়স হয়ে যাওয়া মেসির সেরাটা বার করে নিয়ে আসা।

ব্যক্তিগতভাবে একটা শূন্যতা মনের মধ্যে কাজ করলেও, ফুটবল সেই সুযোগ দেয় না। আজকের দিনে ফুটবল খেলাটা অনেকটা বদলে গেছে। ইউসিএলের নকআউট একরকম আর বিশ্বকাপের নকআউট, যেখানে দু সপ্তাহে দ্রুত চারখানা ম্যাচ জিততে হয় সেটা একদম আলাদা।

দেখবেন, এই ফাইনালে দারুণ খেলা দলের খুব কম প্লেয়ারই ইউরোপের প্রথম সারির ক্লাবগুলোতে হাসতে খেলতে ঢুকে পড়বেন। কিন্তু তাও আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ফ্রান্স অনেক কিছু হারিয়েও রানার্স, এক চুলের জন্য। নক আউট কোচিং এবং টুর্নামেন্ট দল ম্যানেজমেন্টের অনন্য নিদর্শন দুই দলের কোচ রেখে গেলেন। তার জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয় লিও স্কালোনি ও দিদিয়ের দেশঁর জন্য।

সেরা বিশ্বকাপ, সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল এবং সেরা কোচ। এই বিশ্বকাপ থেকে এটাই সবথেকে বড় পাওয়া। আবার ফিরে আসব, খুচরোখাচরা খেলা নিয়ে। তাব তাক কে লিয়ে আলবিদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link