ফিনিক্স পাখির ফিরে আসা!

গ্রামের নাম মুন্সীগঞ্জ। দুই পা বাড়ালেই চুনা নদী। নদী পার হলেই সুন্দরবন। ও পারে বাঘ, এ পারে শেষ মনুষ্যবসতি। বসতির সব জায়গায় এখনো পৌঁছায়নি সভ্যতার ছোঁয়া, পৌঁছায়নি বৈদ্যুতিক আলো।

বিদ্যুত্ না থাকলেও টেলিভিশনের অভাব নেই। মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে ব্যাটারি কিংবা সৌর বিদ্যুতে চলে টেলিভিশন। বিকাল হলেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে লোকে ভিড় জমায় টেলিভিশনের সামনে। এই কদিন আগেও টেলিভিশনগুলো দখলে ছিল শাকিব খান, অনন্ত জলিল কিংবা কয়েক মাইল ওপাশের ভারতীয় কোনো নায়কের অনুষ্ঠানে।

সেই চিত্র বদলেছে। টেলিভিশনে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীর আধিপত্যের দিন শেষ।

বিকাল হলেই এখন সুন্দরবনের কোলে টেলিভিশনগুলোতে ব্যাট-বলের ঝনঝনানি। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে শুরু করে সিপিএল, আইপিএলের খেলার পুনঃপ্রচার চলে অনবরত। খেলা যারই হোক, লোকের ক্রিকেট দেখায় কোনো ক্লান্তি নেই। কেবল মাঝে মাঝে কোনো এক কণ্ঠ শোনা যায়, ‘আচ্ছা, আমাগো ছলডা কি খেলতিছে?’

উত্তর যাই হোক, অবিরাম ক্রিকেট অনুসরণ করে মানুষগুলো। অপেক্ষায় থাকে, তাদের ছেলেটার খেলা দেখার। হ্যাঁ, মুস্তাফিজুর রহমানের খেলা দেখার।

ছেলেটা যেমনেই খেলুন, ওই টিভিগুলো চলতেই থাকে। আর টিভির সামনে মানুষগুলো অপেক্ষায় থাকে, কবে আবার তাদের ‘ছলডা’ আগের মতো খেলবে। কবে আবার ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা লুটোপুটি খাবে সেই মুস্তাফিজের জাদুতে।

সেই অপেক্ষার কী শেষ হলো?

বলা খুব মুশকিল। সেই ২০১৬ সালের পর থেকে অনেকবারই নিজেকে ফিরে পেয়েছেন বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সেই রূপটা সত্যি সত্যি ফিরে পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্টস কাপে দূরন্ত বোলিং করার পর এই বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে আসলে আরেকবার স্বপ্নটাকে ছড়িয়ে দিলেন।

এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে ১০ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে কেবল সেরা বোলার হননি। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটাও গেছে তার ঝুলিতে। সুতরাং স্বপ্ন মুস্তাফিজকে নিয়ে আরেকবার দেখা যেতেই পারে।

অথচ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলেন এই এক সময়ের তরুন বিষ্ময়ের।

২০১৫ সালে স্বপ্নের চেয়েও বড় করে অভিষেক হয়েছিলো মুস্তাফিজের। পরপর দুই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১১ উইকেট নিয়ে দলটিকে সিরিজে হারিয়েছিলেন। এরপর ওই বছর আরও একবার ম্যাচে ৫ উইকেট নেন। সেটা ছিলো স্বপ্নের বছর। কিন্তু পরের বছর থেকে একটু একটু করে পথ হারাতে থাকেন।

সুনির্দিষ্ট করে বললে ২০১৬ সালে কাউন্টি খেলতে গিয়ে যে চোটে পড়েছিলেন, তারপর থেকে আবার একটানা পারফরম করতে পারেননি। মাঝে মাঝে হঠাৎ ঝলক দেখা গেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপে যেমন অনেকগুলো উইকেট পেয়েছিলেন। ৮ ম্যাচে ২০ উইকেট; এর মধ্যে দু বার ৫ উইকেট শিকার। কিন্তু বোলিং খুব ‘কনভিন্সিং’ ছিলো না।

এ ছাড়া টেস্টে একেবারে ‘পরিকল্পনা’ থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছিলেন। বলা হচ্ছিলো তার বোলিং এতোটাই অনুমিত হয়ে গেছে যে, টেস্টে সেটা আর চলবেই না। টেস্টে ফিরতে গেলে তাকে বোলিং বদলে আসতে হবে।

এই অবস্থায় মুস্তাফিজকে কিছুটা লাইফলাইন দিলো প্রেসিডেন্টস কাপ। ৮টা উইকেট পেলেন ৪ ম্যাচে। তার চেয়ে বড় কথা বোলিংয়ে ধারটা দেখা গেলো। যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো, সেই বলকে ভেতরে ঢোকাতে পারছেন বলেই মনে হচ্ছিলো। ফলে মুস্তাফিজকে আবার বিবেচনায় নেওয়ার একটা আলাপও শুরু হয়ে গেলো।

এর মধ্যেই এলো বঙ্গবন্ধুটি-টোয়েন্টি কাপ।

আর এখানেই দারুন একটা রূপ দেখালেন মুস্তাফিজ। না, কাটারের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, তা নয়। তবে পুরো টুর্নামেন্ট দারুন নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। আর দেখে মনে হয়েছে, বোলিংটা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তার ফলও পেলেন হাতেনাতে। গুনে গুনে ২২টা উইকেট পেয়ে সেরার খেতাব জিতে নিলেন।

এখন মুস্তাফিজ ফিরে এসেছেন, এমন উপসংহারে পৌছে যাওয়া হয়তো ঠিক হবে না। তবে মুস্তাফিজকে নিয়ে আরেকবার স্বপ্ন তো দেখাই যায়। অন্তত বাংলাদেশ দলের কোচরা এটুকু নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, এই ছেলেটিকে নিয়ে কাজ করলে আগের রূপেই ফিরে পাওয়া সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link