কান্ডারী হুশিয়ার!

বিপিএলে দর্শক খরা নতুন নয়। এই খরার মাঝেও মাঠের ক্রিকেটে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন একজন। তিনি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২০১৬ বিপিএলের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে! আন্ডার ডগ খুলনা টাইটান্সের নেতৃত্বের ভার নিয়ে মাঠে নামেন রিয়াদ। প্রথম ম্যাচেই দেখালেন চমক, শেষ ওভারে করলেন ৭ রান ডিফেন্ড।

স্লগ ওভারের বোলার সংকট দীর্ঘদিনের আক্ষেপ হয়তো রিয়াদ কে দিয়েই ঘুচে যাবে। একজন অনিয়মিত বোলারের এমন বোলিং আকস্মিক হয়, হরহামেশা নয়। কিন্তু এ কী! পরের ম্যাচে আবারও এই কান্ড ঘটিয়ে রিয়াদের বিস্ময়ের জন্ম। এবার করেন আগের চেয়ে এক রান কম ডিফেন্ড। টি-টোয়েন্টি স্টার আফগান হার্ডহিটার মোহাম্মদ নবী ব্যর্থ রিয়াদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্পিন বোলিংয়ে। ব্যাট, বল ও অধিনায়কত্ব তিনদিকেই নিজেকে মেলে ধরলেন পুনরায় রিয়াদ।

রিয়াদের অধিনায়কত্বের গল্প নতুন কিছুই নয়। বিপিএলের সকল আসরেই এই দায়িত্বাভার তাকে নিতে হয়েছে। প্রতিবারই দল কে সাফল্য এনে দিতে চূড়ান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। নকআউটে পৌঁছেছেন বেশ কয়েকবার। ফাইনালে পা কাটার গল্পও কম নয়। বিশেষত, ২০১৫ বিপিএল ফাইনালের করুণ পরিণতি কে ভুলতে পারবে!

দর্শকদের জন্য ক্রিকেটের এক রোমাঞ্চে ভরপুর ম্যাচ হলেও রিয়াদের জন্য ছিলো অবিশ্বাস্য এক পরাজয়। ব্যাট-বলে, অধিনায়কত্বে সমান তালে লড়েছিলেন সেদিন রিয়াদ। শুধু সময়টা তার বিপক্ষে ছিলো বলেই শেষ বলের পরাজয়ে আসেনি ঘরে কাপ।

বিপিএল ফাইনালে হেরেছেন দুবার। মজার বিষয়, দুবার-ই প্রতিপক্ষের অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি। রিয়াদের পারফরম্যান্স ফাইনালে গা ঢাকা না দিলেও, ফ্লাড লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করেছেন সবসময় মাশরাফি। মুদ্রোর উল্টোপিঠে শুধু রিয়াদের আক্ষেপ ভরা চেহারার দেখা মিলেছে। তবে এবার গল্পটা ভিন্ন। বিসিবি আয়োজিত করোনা পরবর্তী দুই শিরোপাই রিয়াদের দখলে। দুই আসরেই রিয়াদ ব্যাটে-বলে, অধিনায়কত্বে সমান তালে লড়েছেন।

এবারের আসরে দলের মূলশক্তি অভিজ্ঞতা কে পুঁজি করে এগিয়ে গেছেন। তারুণ্যের উদ্যম কেও কাজে লাগিয়েছেন নিখুঁতভাবে। সাকিব কে দলে পেয়ে অনেকখানি নির্ভারও হয়েছেন, মাঝপথে মাশরাফির দলে অন্তর্ভূক্তি বাড়তি প্রেরণা জুগিয়েছে রিয়াদকে। ট্রফি হাতছাড়া হওয়ার তো আর উপায় নেই। যার কাছে বারবার ট্রফি হারিয়েছে তাকেই এবার দলে টেনে নিয়েছে।

যদিও এই কথাগুলো নিছক বিনোদন ছাড়া আরকিছুই নয়। রিয়াদ শতভাগ যোগ্য হিসেবেই বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ জিতেছে। দল কে মাঠে সার্বক্ষণিক চাঙা রাখা। সময়ের চাহিদার উপর নির্ভর করে বোলিং ও ফিল্ডিংয়ের পরিবর্তন। দল তৈরিতে নিজের বোঝাপড়ার জায়গা কে প্রাধান্য দেওয়া। সেই ২০১২ থেকেই আরিফুল বিপিএলে রিয়াদের দলে খেলে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতেও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি।  অধিনায়কের সাথে উচিত বোঝাপড়া আরিফুলের এবারের নৈপুণ্যে স্পষ্ট। বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সদস্য শামীমের এমন ফিল্ডিংয়ে গর্বে বুকটা তো রিয়াদের-ই বেশি ভারি হয়েছে।

সংকটাপন্ন মূহুর্তে রিয়াদ ব্রেক থ্রু দিতে জানেন। ব্যাট হাতে দ্রুত রান বের করতে পারেন। ম্যাচ কে ভালো পড়তে জানেন। চাহিদানুযায়ী অবদান রাখতে জানেন। মাঠে সর্বদা মনযোগ রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারার পারদর্শিতা রয়েছে। তেরো বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সব অভিজ্ঞতা কে একত্র করতে জানেন।

অধিনায়কত্বের ভারে রিয়াদ যেন পাল্টে যান। রিয়াদের ব্যক্তিত্বে ধরা দেয় দারুণ কিছু। নিজের খেলায় নিয়ে আসেন পরিবর্তন। যাকে মূলত দায়িত্বশীল বলা হয়। স্লগের ওভার গুলোয় ব্যাট হাতে নিজেই দায়িত্ব নিতে পছন্দ করেন, তাই সময়ের চাহিদানুযায়ী টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে রিয়াদ তিন থেকে ছয় – সকল পজিশনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেন। জাতীয় দলে ক্রাইসিস ম্যান বনে যাওয়া রিয়াদ অধিনায়কত্ব পেলেও উপরে ব্যাটিং করার লোভ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের উর্ধ্বে স্থান দেন নিজের যেকোনো দল কে। একজন দক্ষ নেতার এই ত্যাগী মনোভাব-ই দল কে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করে।

রিয়াদের মাঝে শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার তাড়না আছে। হেরে যাওয়ার আগে মাঠ ছাড়তে নারাজ ব্যক্তিত্বের একজন রিয়াদ। শেষ দেখেই ছাড়বো মনোবলে এগিয়ে যান সর্বদা। শহিদুল, শামীম, জাকির, হাসান মাহমুদদের মত তরুণদের মাথার উপর ছাতা হয়ে সুপথের নির্দেশনা দিয়েছেন। যে পথে পা বাড়ালেই ধরা দেয় সফলতা। একজন অধিনায়কের মাঠে সবচেয়ে বড় গুণ হলো সবকিছু স্বাভাবিক রাখা। স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত না হওয়া।

ফাইনালে জাকির যখন ফাইন লেগ ফিল্ডারের ক্যাচ নিজে লুফে নেওয়ার চেষ্টায় বলের জায়গাটাই মিস করেন, রিয়াদ তখনও চুপচাপ ছিলেন। জাকির কে একবারের জন্যেও বকাঝকা করেননি। নার্ভ গেমে সতীর্থ কে কথা দ্বারা অপ্রস্তুত না করে দেওয়া অধিনায়কের ভূমিকার আওতায় পড়ে। যতটুকু হাসিখুশি পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব, ততটুকুই করেছেন। মাঠে সবকিছু স্বাভাবিক রেখেছেন চাপ পরিহার করে। শেষ ওভারে শহিদুলের নেওয়া পরপর দুই উইকেটেও সতীর্থদের তেমন উল্লাস করতে দেননি। ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার খেলা, তাই জয়ের আগ পর্যন্ত উল্লাস নয়, আবার হারার আগেও হাল ছাড়া নয়।

শহিদুল তরুণ বোলার। বাবা হারানোর শোক নিয়ে ফাইনালে মাঠে নেমেছিলেন। দলের লক্ষ্য ছিলো শহিদুল ও তার বাবার জন্য এই ম্যাচ জিততে হবে। তাই শহিদুলের স্বাভাবিক জীবন কে চাঙা করার প্রচেষ্টায় সঠিক সিদ্ধান্ত কাপ্তান রিয়াদের। শেষ ওভারের মোক্ষম সময়ে ডেকে আনলেন। শোক কে শক্তিতে পরিণত করার সুযোগ দিলেন। রিয়াদ হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আজকে শহিদুলের দিন।

পরিপক্ব ও পরিণত বোলারের আচরণ দেখা গেছে শহিদুলের বলে। স্লগে সচরাচর এমন বুদ্ধিবৃত্তিক বোলিং আশা করা দুস্কর বাংলাদেশি সিমারদের কাছ থেকে। প্রতি বলে শহিদুলের কাছে গিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে বলে শিশির মুছতে মুছতে কথা বলেছেন। শহিদুল একা নও তুমি! বিশ্বাস তৈরি করে দিতে গিয়েছিলেন। আত্মবিশ্বাসের চাকায় গতি বাড়িয়েছেন। যেভাবে বল করলে দল ও নিজের মানসিক তৃপ্তি লাভ করা যাবে; তাই করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। শহিদুল পেরেছেনও বটে। হয়তো অধিনায়ক ছাতা হয়ে আশা দেখানো তেই।

ম্যাচশেষে রিয়াদের ক্ষণিকের উল্লাস দেখেছেন? চেহারায় কেমন আবেগ ফুটে উঠেছিলো ? দীর্ঘদিনের না পাওয়ার বেদনা অতলে তলিয়ে গেছে। ম্যাচশেষ জহুরুল যখন তাকে জড়িয়ে ধরলো, কি এক অদ্ভুত কোটি টাকার দৃশ্যই না তৈরি হলো মিরপুর শেরে বাংলায়। এই আলিঙ্গন ভর্তি ছিল ভালোবাসায়। এই আলিঙ্গন প্রাপ্তির।

রিয়াদ আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন কিংবদন্তি; তাকে ঘিরে এই আলোচনা এখন উন্মুক্ত গোপন কথা। পুরো দল কে কাঁধে তুলে এগিয়ে গেছেন, একবারের জন্যেও পিছ পা হননি। সম্মানটুকু তো প্রাপ্য। তাই সতীর্থরাও কাঁধে তুলে সম্মান জানাতে তাই ভুলে করেনি। একটা নয় টানা দুটো বিসিবি কাপের ট্রফি নামের পাশে লিখিয়েছেন ২০২০ সালে। এই বছর করোনার বছর হওয়া থেকে পথের দিক পাল্টে দিতে একজন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ-ই যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link