গোলের খেলা ফুটবলে ‘কালোমানিক’ পেলের হাজারের বেশি গোলের রেকর্ড নিয়ে সন্দেহ আছে বিস্তর। পেলের চলে যাওয়ার দিনে শোকাবহ পৃথিবীতে বারবার মনের কোণায় জানান দিয়ে যায় সেই প্রশ্নগুলোও। আসলেই কি পেলে এক হাজারের বেশি গোল করেছিলেন?
ফুটবল ইতিহাসের প্রথম বৈশ্বিক তারকা পেলে। ব্রাজিলকে তিনবার বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি সান্তোসের হয়ে ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন দুবার। প্রায় দুই দশকের ফুটবল ক্যারিয়ারে তাঁর মোট গোলসংখ্যা ধারণা করা হয় ১২৮১ কিংবা ১২৮৩টি। কখনো ইউরোপে না খেলা পেলে বেশিরভাগ গোলই করেছেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসের হয়ে। তবে জাতীয় দলের জার্সিতেও ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল আছে তাঁর।
তবে পেলের হাজারের বেশি গোলসংখ্যা নিয়ে বারবারই নানা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। বিখ্যাত এক ইংরেজ সাময়িকী তো একবার লিখেছিল, ‘পেলে বোধহয় গোসলের সময় দিবাস্বপ্নে দেখা গোলগুলোও হিসেব করেছেন। নইলে তো আর হাজার গোল সম্ভব হতে পারে না।’ আবার অনেকে মজা করে বলতেন যে পেলে বোধহয় তাঁর অভিনয় করা ‘এস্কেপ টু দ্য গোল’ সিনেমায় যেসব গোল করেছিলেন সেগুলোও হিসেবে নিয়েছেন। আসলেই কি তবে পেলে এতগুলো গোল করেননি?
সমালোচকদের দাবি পেলের ক্যারিয়ারের ৫২৬ গোলই এসেছে ক্লাবের নানা ট্যুর কিংবা প্রীতি ম্যাচগুলোতে যেসব ম্যাচের কোনো স্বীকৃতি নেই। যদিও সে সময়টাতে এরকম প্রীতি ম্যাচের প্রচলন ছিল, দর্শকেরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতেন ক্লাবগুলোর প্রীতি ম্যাচের জন্য। তবে সেই ম্যাচগুলো মোটেও প্রীতি ম্যাচের আবহে হত না, প্রতিটা দলই নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দিত জয়ের জন্য।
অনেকে দাবি করেন পেলের সে সময়টাতে অফ সাইডের নিয়ম না থাকাতেই তিনি এতগুলো গোল করতে পেরেছেন। তবে চিরায়িতভাবেই পাল্টা প্রশ্ন উঠে আসে অফ সাইডের নিয়মটা তো কেবল পেলের একার জন্য নয়, সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল। তাহলে বাকিরা কেন গোল করতে পারেননি? আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, জার্ড মুলার, ফেরেংক পুসকাসের মত কিংবদন্তিরাও একই সময়ে খেলে গেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই গোলসংখ্যায় পেলেকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
কয়েকজন অবশ্য দাবি করেন পেলে ইউরোপিয়ান ফুটবল খেললে কখনোই এতগুলো গোল করতে পারতেন না। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে নাকি বড় দলের সাথে ছোট দলের পার্থক্য খানিকটা বেশি। অথচ সমালোচকদের এই দাবিটাও খানিকটা গোলমেলে। আজকের দিনের তুলনায় হয়তো ইউরোপিয়ান ফুটবলের সাথে লাতিনের ক্লাবগুলোর পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালীন সেই সময়টার চিত্র খানিকটা আলাদা। সেকালে ব্রাজিলিয়ানরা নিজেদের লিগেই খেলতে পছন্দ করতেন।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের প্রায় পুরো দলটাই খেলতো ঘরোয়া লিগে। পেলে নিশ্চিতভাবেই লিগের সেরা আকর্ষণ ছিলেন, কিন্তু একমাত্র নন। গ্যারিঞ্চা, ভাভা, দিদিদের মতো তারকা ফুটবলাররা সে সময় রাজত্ব করতেন ব্রাজিলিয়ান লিগে। গোল করা এতটা সহজ হলে নিশ্চয়ই তাঁরাও পেলের চাইতে খুব একটা কম গোল করতেন না। তাছাড়া ১৯৬২ ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ম্যাচে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন বেনফিকাকে দুই লেগ মিলিয়ে ৮-৪ গোলে হারিয়েছিল সান্তোস। তারকা ঠাসা সেই দুই ম্যাচের প্রথম লেগে জোড়া গোলের পর দ্বিতীয় লেগে হ্যাটট্রিক করেছিলেন পেলে।
তাছাড়া তর্কের খাতিরে পেলের আনঅফিশিয়াল ম্যাচে করা ৫২৬ গোল বাদ দিলেও ক্যারিয়ারে মোট গোলের সংখ্যা ৭৫৭টি। মাত্র ৮১২ ম্যাচে এত সংখ্যক গোল করেন তিনি। ম্যাচপ্রতি গোল করায় তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি কেউই। এছাড়া বড় ম্যাচগুলোতে পেলের পারফরম্যান্সও তাঁর পক্ষেই কথা বলবে। ঘরোয়া লিগের ফাইনালে ১৩ ম্যাচ খেলে ১১ গোল করেছেন তিনি। এছাড়া আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৭৭ গোল তো আছেই।
২০২২ সালে মেসির কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর পেলের একাধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু পেলের গোল করার দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়।