কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের দুই সতীর্থ লিওনেল মেসি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে। একদিকে মেসির শেষ বিশ্বকাপ, অন্যদিকে টানা দুই বিশ্বকাপ জিতে এমবাপ্পের সামনে অমরত্বের হাতছানি। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ বীরত্বে শেষ হাসি হেসেছিলেন মেসিই, বৃথা গিয়েছিল এমবাপ্পের অনবদ্য হ্যাটট্রিক। বিশ্বকাপ শেষে দুজনেই ফিরেছেন ক্লাবের ডেরায়। লক্ষ্যটা এবার ক্লাবের জার্সিতে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব জেতা।
প্যারিসে ফিরেই দারুণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন মেসি। অন্যদিকে, এমবাপ্পে যোগ দিয়েছেন দুই সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে, খানিকটা নীরবে নিভৃতে। সবাই ভেবেছিলেন ফাইনালের জের ধরে এই দুই তারকার মধ্যে ফাটল ধরতে বাধ্য। তাছাড়া পার্ক দে প্রিন্সেসের তারকা সামলানোর পূর্বের রেকর্ডও তো আশানুরূপ নয়।
মৌসুম শুরুর আগে ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারের সাথে অনুশীলনেই লেগে গিয়েছিল এমবাপ্পের। ইনজুরিতে থাকা মেসি সে সময়ে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমবাপ্পে বলেছিলেন, ‘আমাদের মাঝে এমন বাদানুবাদ আগেও হয়েছে এবং এতে কোনো সমস্যা দেখছি না। আমাদের লক্ষ্যটা একই, আমরা জিততে চাই।’
মেসি এবং নেইমারের বন্ধুত্বের জমাট রসায়নের কথা সেই বার্সেলোনার দিনগুলো থেকে শুরু। ফলে দলের আরেক তারকা এমবাপ্পে নিজেকে খানিকটা নিঃসঙ্গ ভাবতেই পারেন। তাছাড়া দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন। দিন কয়েক আগে নেইমারের সাথে পেনাল্টি কিক কি নেবেন সেই নিয়ে মাঠের মধ্যেই তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরপর সম্পর্কে ফাটল ধরার গুঞ্জন ক্রমশই জোরালো হয়েছে।
মৌসুমের মাঝপথেই শোনা গিয়েছিল পিএসজিতে আর থাকতে চান না এমবাপ্পে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া ফুটবলার হওয়া সত্ত্বেও চুক্তির মেয়াদ বাকি থাকতেই ছাড়তে চেয়েছিলেন প্যারিস। প্রকাশ্যেই এমবাপ্পে জানিয়েছিলেন ক্লাব ছাড়তে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
এরপরই দৃশ্যপটে আসে বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুম। ক্লাব ফুটবল ছেড়ে ফুটবলাররা শুরু করেন বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রস্তুতি। এরমাঝেই পিএসজি খানিকটা নীরবেই লিগা ওয়ানে শীর্ষস্থান নিশ্চিতের পাশাপাশি উঠে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে।
তিন তারকা একত্রে গোল করেছেন, উদযাপন করেছেন, মাঠ এবং মাঠের বাইরে তাঁদের সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে। গড়ে তুলেছেন ক্লাবগুলোর স্বপ্নের আক্রমণাত্নক ত্রয়ী। বিশ্বকাপের আগে নেইমার ২১ গোলে অবদান রেখেছেন, মেসি ১৭ গোল এবং এমবাপ্পে রেখেছেন ১৫ গোলে।
কিন্তু বিশ্বকাপ শেষেই বদলে গেছে দৃশ্যপট। ফাইনালে হ্যাটট্রিক সত্ত্বেও মেসির আর্জেন্টিনার সাথে পেরে ওঠেনি এমবাপ্পের ফ্রান্স। ফাইনালের পর আর্জেন্টিনার ড্রেসিংরুমে এমি মার্টিনেজ এমবাপ্পেকে ব্যঙ্গ করেছেন, আগুয়েরো বিতর্কিত সব মন্তব্য করেছেন। মেসি নীরবে দেখে গেছেন সব, প্রতিবাদ করেননি।
ফাইনাল হারের ৭২ ঘন্টার মাঝেই দলের সাথে অনুশীলনে যোগ দিয়েছিলেন ফরাসি এই তারকা। প্রথম ম্যাচেই পেনাল্টি থেকে জয়সূচক গোল করেন তিনি। কিন্তু ম্যাচশেষে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন না করে বরং সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মেসির সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। এমবাপ্পে সেই সংবাদ সম্মেলনে এড়িয়ে গিয়েছিলেন স্পর্শকাতর এই ব্যাপারগুলো। এরপর লেন্সের বিপক্ষে লজ্জার এক হারের পর দুই সপ্তাহের ছুটিতে যান এই তারকা।
অন্যদিকে, প্রায় এক মাসের ছুটি কাটিয়ে দলে ফেরেন মেসি। প্রথম দিনের অনুশীলনে তাঁকে নেইমারের সাথে হাস্যরস করতে দেখা যায়। ক্লাবও যথার্থ সম্মান জানিয়েছে তাঁকে, পুরো ক্লাব গার্ড অব অনারে দিয়েছেন মেসিকে। প্রথম ম্যাচেই অ্যাঞ্জার্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক গোল করে দলকে জয়ের ধারায় ফেরান লিটল ম্যাজিশিয়ান।
সংবাদমাধ্যমে কেউ মুখ না খুললেও বোঝা যাচ্ছে কোথাও যেন সেই পুরনো সুরটা কেটে গেছে। আগের সেই সম্পর্কটা নেই তাঁদের মাঝে। তবে ফুটবলে সাফল্য পেতে বন্ধুত্ব পূর্বশর্ত নয়। এর আগেও ক্লাবের তারকাদের বাজে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সাফল্য পেয়েছে ক্লাবগুলো।
নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত কাটাচ্ছেন মেসি, অন্যদিকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়ছেন এমবাপ্পে। বিশ্বকাপের আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল পিএসজি তারকারা একে অন্যের মুখোমুখি হতে পারেন কাতারের মঞ্চে। কিন্তু সেটা যে ফাইনালের মঞ্চেই হবে, সেটা বোধহয় ধারণা করতে পারেননি কেউই।
পিএসজি কোচ গালতিয়ের অবশ্য দাবি করেছেন ড্রেসিংরুমে সবকিছু ঠিক আছে, সবাই সংঘবদ্ধই আছেন। কিন্তু সাধারণ ফুটবলপ্রেমীই মাত্রই বুঝতে পারবে কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। বিশ্বকাপের পর এখনো একসাথে মাঠে নামেননি মেসি এবং এমবাপ্পে।
তবে তাঁদের মূল পরীক্ষা দিতে হবে ভালোবাসা দিবসের রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। ইনজুরিজর্জর বায়ার্ন বুন্দেসলিগার শিরোপা ধরতে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। তা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সব সময়েই তাঁরা শক্ত প্রতিপক্ষ। এখন দেখার বিষয় অভ্যন্তরীণ ঝামেলা মিটিয়ে পরম আরাধ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিততে পারে কিনা পিএসজি।