গ্যারি লিনেকার, ফুটবলের অলরাউন্ডার

আশির দশকটা ছিল ক্রীড়াপ্রেমীদের স্বর্ণযুগ। ক্রিকেটে শেষের শুরু দেখছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্যাট হাতে রাজত্ব করছেন সুনীল গাভাস্কার নামের এক ভারতীয়। ফুটবলে পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করে যাচ্ছেন দিয়েগো ম্যারাডোনা নামের এক জাদুকর।

বারবার বিতর্কে জড়াচ্ছেন, হাত দিয়ে গোল করছেন – তবুও ভক্তদের ভালোবাসার কমতি নেই। ইংল্যান্ডে খানিকটা নীরবে নিভৃতেই নিজের কাজটা করে যাচ্ছেন এক স্ট্রাইকার। গোলের কমতি নেই, তবুও শিরোপার যেন অধরাই থেকে যাচ্ছিল।

তিনি গ্যারি লিনেকার, ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ফুটবল ইতিহাসের তিনি অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। হোক সেটা মাঠে, কিংবা মাঠের বাইরে।

১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল এবং ক্রিকেট দুই খেলাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন লিনেকার। কিন্তু শহরের ক্লাব লিস্টার সিটির হয়ে খেলার নেশায় যোগ দেন ফুটবল একাডেমিতেই।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে খেলতেন উইঙ্গার হিসেবে, ফলে গোলের দেখা পাননি তেমন। কিন্তু পরবর্তীতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা শুরু করতেই নিজের স্বরূপে ফেরেন লিনেকার। আর এটাই পাল্টে দেয় ইংল্যান্ড ‍ফুটবলের স্বপ্ন।

১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে ২২ গোল করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন। যদিও তাঁর দল লিস্টার খুব একটা ভালো করতে পারেনি সে মৌসুমে। পরের মৌসুমে ২৪ গোল করে জেতেন গোল্ডেন বুটের খেতাব।

টানা সাত বছর খেলেছেন নিজের শহরের ক্লাবে। ১৯৮৫ মৌসুমে তাঁকে দলে ভেড়ায় তৎকালীন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এভারটন।

এভারটনের হয়ে পুরো মৌসুমটা কাটান স্বপ্নের মতো। লিগে ৩০ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি জেতেন সেরা ফুটবলারের খেতাব। কিন্তু আরো একবার শিরোপার খুব কাছে থেকে ফিরতে হয় তাঁকে। লিগে দ্বিতীয় হবার পাশাপাশি এফএ কাপের ফাইনালে হেরে যায় এভারটন।

দারুণ ফর্মে থেকেই জাতীয় দলের হয়ে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ খেলতে যান লিনেকার। বিশ্বকাপেও বজায় রাখেন গোলের ধারা, ছয় গোল করে নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। যদিও শিরোপা জেতা হয়নি, কোয়ার্টার ফাইনালে দিয়েগো ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে খালি হাতেই ফিরতে হয় ইংলিশদের। 

বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পর তাঁকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো। টেকনিক্যালি অনবদ্য না হলেও গতি, ঠান্ডা মাথার ফিনিশিংয়ের জন্য আলাদা সুনাম কুড়ান তিনি। ইংল্যান্ড ছেড়ে তিনি পাড়ি জমান স্পেনের উদ্দেশ্যে, যোগ দেন কাতালান জায়ান্ট বার্সেলোনায়।

নিজের প্রথম মৌসুমেই এল ক্ল্যাসিকোতে হ্যাটট্রিক করেন এই ইংলিশ তারকা। লা লিগায় ২০ গোল করে নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। বার্সেলোনার হয়ে তিন মৌসুমে মোট ৫২ গোল করেন লিনেকার। 

১৯৮৯ মৌসুমে পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন তিনি। যোগ দেন উত্তর লন্ডনের ক্লাব টটেনহ্যামে। প্রিমিয়ার লিগে ফিরেই ২৪ গোল করে তৃতীয়বারের মতো জেতেন সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। ক্লাবকে জেতান এফএ কাপের শিরোপা, তিন মৌসুমে ১৩৮ ম্যাচে ৮০ গোল করেন টটেনহ্যামের হয়ে। তিনটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ গোল করা একমাত্র ফুটবলার তিনি। 

গোলের ধারাটা ধরে রেখেছিলেন জাতীয় দলের হয়েও। যদিও বড় কোনো ট্রফি জিততে না পারার আক্ষেপ তাঁকে পুড়িয়েছে আজীবন। থ্রি লায়ন্সদের হয়ে ৮০ ম্যাচে ৪৮ গোল আছে তাঁর। খেলার মাঠে নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে সুখ্যাতি ছিল চতুর এই স্ট্রাইকারের।

দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই কার্ড দেখতে হয়নি তাঁকে। ১৯৯৪ সালে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নেন তিনি। মাঠ থেকে অবসর নিলেও ফুটবল ছাড়তে পারেননি লিনেকার। বিবিসি রেডিওর হয়ে ফুটবল বিশেষজ্ঞ হিসেবে দারুণ সুখ্যাতি পান।

টানা পাঁচ বছর ধরে তিনি ছিলেন বিবিসির সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া বিশেষজ্ঞ। অর্থের অংকটাও কম নয়, প্রায় ১.৭৬ মিলিয়ন ইউরো! এই তালিকায় তিনি পেছনে ফেলেছেন কিংবদন্তি অ্যালান শিয়েরার, স্টিভ রাইট, হিউ এডওয়ার্ডস, স্কট মিলসদের। অলরাউন্ডার শব্দটা তাই গ্যারি লিনেকারের সাথেই ভালো মানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link